• ৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ৫ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

এক দশকেও দুই খুনিকে দেশে ফেরাতে পারেনি সরকার

bijoy71news
প্রকাশিত ডিসেম্বর ১৪, ২০২৩
এক দশকেও দুই খুনিকে দেশে ফেরাতে পারেনি সরকার

পশ্চিম পাকিস্তানের থাবা থেকে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনার আগ মুহূর্তে জাতির সূর্য সন্তানদের হারিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চালানো পাক হানাদার বাহিনীর এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বরেণ্য শিক্ষক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পীসহ রাজনৈতিক ও দার্শনিক মহলের বহু বুদ্ধিজীবী। এই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী। চোখে কালো কাপড় ও পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের ক্ষত বিক্ষত লাশ খুঁজে পাওয়া যায় রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিসহ বিভিন্ন জায়গায়। এদের মধ্যে অনেককেই খুঁজে পাওয়াও যায়নি, শনাক্ত করা যায়নি বহু লাশ। জাতির মেধাবী সন্তানদের হারানোর কারণে ৫২ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশ আজও বুদ্ধিজীবী শূন্যতায় ভুগছে বলে মনে করেন দেশের সচেতন মানুষ। একইসঙ্গে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল দুই হোতা চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানকে বিচারের মুখোমুখি করতে না পাওয়ার আক্ষেপ রয়েছে সর্বস্তরে।

 

এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানকে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তবে মঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে ও আশরাফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করায় এই দুই ঘাতককে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়নি।

গত রবিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত ব্রিফিং এ মুখপাত্র এবং জনকূটনীতি অনুবিভাগের মহাপরিচালক সেহেলী সাবরীন জানান, শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে প্রমাণিত খুনী চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানকে বিদেশ থেকে ফেরাতে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত আছে। এক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া চলমান আছে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। তবে আন্তর্জাতিক মহলে যে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রয়োজন ছিল সেখানে ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানেরা।

শহীদ বুদ্ধিজীবী সন্তানদের আক্ষেপ

শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের সন্তান লেখক ও সাংবাদিক জাহীদ রেজা নূর ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আশায় বুক বেঁধে ছিলাম। এরমধ্যে অনেকেই পরিবারের আরও প্রিয়জনদের হারিয়েছে। অনেকের মা বেঁচে নেই। আমাদের অগ্রজেরা চলে যাচ্ছেন। কিন্তু এই দুই ঘাতকের বিচার দেখে যেতে পারেন নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের অনেকের বিচার হয়েছে। কিন্তু এই পলাতক আসামীদের বিচারের আওতায় আনা জরুরি ছিলো। এই দুই মূল হোতার বিচারের লক্ষ্যে বাংলাদেশের ‘গণহত্যা’র স্বীকৃতি আগে আদায় করতে হবে। আমরা তো সে লড়াই এখনো লড়ে যাচ্ছি। আর ‘জেনোসাইড’ এর মধ্যেই ‘এলিটোসাইড’ এর বিষয়টা থাকে। পরবর্তী প্রজন্ম যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে লক্ষ্যেই যুদ্ধের সময় জাতিকে মেধাশূন্য করা হয়।’

শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর কন্যা ডা. নুজহাত চৌধুরী ঢাকা টাইমসকে জানান, যারা বিদেশে পলাতক আছে তাদেরকে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত এই বিচার কাজ শেষ হবে না। একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেঁচে থাকা যুদ্ধাপরাধীরদের বিচারের আওতায় না আনা পর্যন্ত এই বিচারকাজ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

রুয়ান্ডা, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও আর্মেনিয়া এই দেশগুলো গণহত্যার স্বীকৃতি পেলে বাংলাদেশের ইতিহাসে এই নৃশংস গণহত্যার স্বীকৃতি কেন মেলছে না বলেও হতাশা ব্যক্ত করেছেন শহীদ সন্তান জাহীদ রেজা নূর।

খুনীরা যেসব দেশে পলাতক রয়েছে সেসব দেশে ‘গণহত্যা’ ও ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা’ কে কেন্দ্র করে জনমত তৈরিতে সরকারের ঘাটতি রয়েছে বলেও মনে করেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানেরা।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন বা রক্ষা করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারবার। ৫২ বছর পর বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে বিভিন্ন মহলে। এদেশে আজও জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করছেন কৃষক, শ্রমিক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মেহনতি মানুষ। গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সর্বোপরি মানবাধিকার অর্জনে লড়াই আজও থামেনি।

বুদ্ধিজীবী শূন্যতার কারণে ৫২ বছর পরেও স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার জায়গা সংকুচিত হয়ে আছে বলেও মত দিয়েছেন লেখক ও সাংবাদিক জাহীদ রেজা নূর। সেসময়ের বুদ্ধিজীবীরা বেঁচে থাকলে বর্তমান সংকটকে চিহ্নিত করে আলোর পথের দিশারী হতে পারতেন বলেও মনে করেন অনেকে।

জাহীদ রেজা নূর প্রশ্ন রাখেন, ‘আমরা এত স্বার্থপর হলাম কেন? যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, গণতন্ত্র, সাম্যতা ও মূল্যবোধ নিয়ে এগোনোর কথা ছিল সেখান থেকে কেন পিছিয়ে গেলাম? রাজনীতি থেকে সব ক্ষেত্রে পেশিশক্তি ঢুকে গেছে। গরীবের রক্ত চুষে খাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। শ্রমিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এই মানুষগুলো বেঁচে থাকলে চিন্তা ও বিবেকের জায়গায় এই শূন্যতা তৈরি হতো না। এছাড়া যারা বেঁচে ছিলেন তারা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শকে টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতি সামগ্রীক ব্যর্থতার নজির।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হতাশা

পলাতক বুদ্ধিজীবী খুনীদের ফেরাতে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার কোনো অগ্রগতি আছে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা চৌধুরী মঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে ও আশরাফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তারা দীর্ঘদিন ধরে সেসব দেশের নাগরিক। তাই এসব দেশ সহজে উত্তর দেয় না। আমরা বলি তারা শুনে না। এই খুনীদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক অভিযোগ করেছি।’

এই সরকারের ১৫ বছরের মেয়াদে এক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘একটা বড় কারণ ১৯৭১ এর পরে দেশে দীর্ঘ বছর এরশাদ ও জিয়া সরকার ক্ষমতায় ছিলেন। এরা এই খুনীদের সুরক্ষা দিয়েছে। এই দীর্ঘ সময় পার হওয়ায় বিদেশে এটা নিয়ে নড়চড় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ১৯৯৬ এ শেখ হাসিনা সরকার আসার পর এই পলাতক খুনীদের বিরুদ্ধে তৎপরতা শুরু হয়েছে।’

দ্বিতীয়ত সরকারের পক্ষ থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের ফেরানোর কথা বললে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্ন ওঠে বলেও অপারগতা প্রকাশ করেছেন ড. মোমেন। বললেও দোষ না বললেও দোষ উল্লেখ করে এক্ষেত্রে সরকারের পরিস্থিতি ‘শাঁখের করাত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

ঢাকা টাইমসকে আরও বলেন, ‘এসকল দেশ খুনীদের আশ্রয় দিয়ে মানবাধিকার রক্ষায় বাহবা কুড়াচ্ছেন। তারা বলেন আমরা ফাঁসি দিয়ে দিব। তাহলে যারা প্রিয়জন ও অভিভাবক হারালেন তাদের ন্যায় বিচার এই উন্নত দেশগুলোর কাছে মুখ্য নয়।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনে করেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচারে তাদের সন্তানদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে।

আইনি প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পরামর্শ ‘শহীদ সন্তানেরা ভিন দেশে এই খুনীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। যারা পরিবার হারিয়েছেন তাদের অভিযোগ অনেক যৌক্তিক হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকার সহায়তা জোরদার করতে পারে।’

চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান এখন সেসব দেশে বড় ধর্মীয় নেতা জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এই ঘাতকরা যেখানে গিয়ে বক্তৃতা দেন, আমি চাইবো শহীদদের সন্তানরা সেখানে গিয়ে যেন বিক্ষোভ করেন। বুদ্ধিজীবীদের ছেলে-মেয়েরা অনেকেই তো বিদেশে আছে। তারা কেন সেখানে প্রতিবাদ জানান না। শুধু শেখ হাসিনার দিকে তাকায় আছেন।’

নতুন প্রজন্মের কাছে প্রত্যাশা

শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের বিষয়ে তার সন্তান জাহীদ রেজা নূর বলেন ‘অবরুদ্ধ বাংলায় থেকেও আব্বা কখনো দালালি করেন নাই। অত্যন্ত সাহসীকতা ও বিবেকের সাথে সাংবাদিকতা করে নিজের প্রাণটা বিলিয়ে গেছেন।’

শুধু বুদ্ধিজীবীদের সন্তানেরাই নয়, যেদিন পুরো জাতি ও তরুণ প্রজন্ম ঐক্যবদ্ধ হয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি তুলবেন সেদিন বিশ্ববিবেকের টনক নড়তে পারে বলে মনে করেন, এই শহীদ সন্তান।

পলাতক খুনীদের ফেরাতে দেশের গণমাধ্যম ও বর্তমান বুদ্ধিজীবী সমাজের কোনো ভূমিকা নেই বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।

১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় রমনা থানায় প্রথম মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নম্বর ছিল ১৫। সেখানে আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মাইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানকে আসামি করা হয়। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৩ সালে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার ফাঁসির আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

এই ট্রাইব্যুনালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষক, ৬ জন সাংবাদিক ও ৩ জন চিকিৎসকসহ ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যাসহ মোট ১১টি অভিযোগ মূলহোতা চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশরাফুজ্জামান খানের নাখালপাড়ার বাসা থেকে এই হত্যা পরিকল্পনা ও টার্গেট বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা পাওয়া যায়। সেখানেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, সাংবাদিক সিরাজউদ্দীন হোসেন, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, ডা. মো. ফজলে রাব্বী, ডা. আলিম চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. মো. মর্তুজা, গিয়াসউদ্দিন আহমেদসহ অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম খুঁজে পাওয়া যায়।