সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেড় কোটি টাকার কার্ডিয়াক অ্যাম্বুলেন্স, ১৯ লাখ টাকার উচ্চপ্রযুক্তির ইটিটি মেশিন উইথ ট্রেডমিল আরগোমিটার ও ৩ লাখ টাকার ডেন্টাল এক্স-রে মেশিন ব্যবহার না হওয়ায় পড়ে আছে। চাহিদার ভিত্তিতে প্রায় দুই কোটি টাকার এ গুলো কেরা হলেও নীতিমালা না থাকায় চাকা ঘুরেনি অ্যাম্বুলেন্সের, আর বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় ব্যবহার হচ্ছে না ইটিটি মেশিন উইথ ট্রেডমিল আরগোমিটার এবং ব্যবহার না হওয়ায় ডেন্টাল এক্স-রে মেশিনতো পড়েই আছে।
হাসপাতালের জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনা হলেও বছরের পর বছর বাক্সবন্দি অবস্থায় পড়ে থেকে সরকারের কোটি টাকা ক্ষতি হয়েচ্ছে। শুধু ওসমানী হাসপাতাল নয়, এভাবে সরকারি আটটি হাসপাতালের জন্য প্রয়োজনহীন বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ক্রয় করে বাক্সবন্দি অবস্থায় পড়ে থেকে সরকারের ২৮ কোটি ৩৮ লাখ ৪৪ হাজার ৮২০ টাকা ক্ষতি হয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের রিপোর্টে এ অনিয়মের বিষয়টি উঠে এসেছে।
মানুষের উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চপ্রযুক্তির যন্ত্রপাতি কিনে থাকে। কখনো প্রয়োজন ছাড়া আবার কখনো স্থাপনের প্রক্রিয়া ঠিক না করেই এসব কেনা হয়ে থাকে। ফলে কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দি হয়ে থাকে। বাক্সবন্দি অবস্থায় এসব নষ্ট হয় বা এগুলোর ওয়ারেন্টি চলে যায়। বিকল বা নষ্ট যন্ত্র মেরামতে বিপুল অর্থ খরচ হয়।
শুধু কমিশন পাওয়ার আশায় এসব মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনার ফলে একদিকে সাধারণ মানুষ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে সরকারের প্রচুর অর্থের ক্ষতি হয়। চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য উচ্চপ্রযুক্তির যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশিকা রয়েছে। কিন্তু এটা না মেনেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরস ডিপো (সিএমএসডি) যন্ত্রপাতি কিনে ফেলে রাখছে।
চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য উচ্চপ্রযুক্তির যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশিকা আছে। ২০১৪ সালের ওই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য উচ্চপ্রযুক্তির যন্ত্রপাতি কেনার পর তা যেন বাক্সবন্দি হয়ে না থাকে, যন্ত্রপাতি স্থাপনের স্থাপনাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা ঠিক করেই যন্ত্রপাতির জন্য চাহিদাপত্র পাঠাতে হবে। কিন্তু চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান চাহিদাপত্র না পাঠালেও যন্ত্রপাতি পাঠায় সিএমএসডি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান নিজে উদ্যোগী হয়ে যন্ত্রপাতি কেনে।
কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের রিপোর্টে জানা গেছে, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য গত ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯ লাখ টাকায় একটি ইটিটি মেশিন উইথ ট্রেডমিল আরগোমিটার কেনা হয়। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় মেশিনটি ব্যবহার করা যায়নি। এ ছাড়া ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ৩ লাখ ১২ হাজার ৯০০ টাকার একটি ডেন্টাল এক্স-রে মেশিন কেনা হয়। এটিরও ব্যবহার হয়নি। ২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল হাসপাতালে একটি কার্ডিয়াক অ্যাম্বুলেন্স বরাদ্দ দিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়। ১ কোটি ৫২ লাখ ৯০ হাজার ৯৭৯ টাকার একটি অ্যাম্বুলেন্স ২০২০ সালের ১৭ অক্টোবর পাঠানো হয়। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স চালানোর নীতিমালা না থাকায় এটি চালানো হয়নি।
এদিকে, ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রবেশপথের পাশে খোলা আকাশের নিচে পাশাপাশি রাখা হয়েছে আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) সুবিধাসংবলিত বিশেষায়িত তিনটি অ্যাম্বুলেন্স।
এর মধ্যে দুটি বাংলাদেশ-ভারতের পতাকাসংবলিত। সে দুটিতে লেখা- ‘ফরম দ্য পিপল অব ইন্ডিয়া টু দ্য পিপল অব বাংলাদেশ’। এর পাশেই রাখা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ পাওয়া কার্ডিয়াক অ্যাম্বুলেন্সটি। তিনটি অ্যাম্বুলেন্সেরই বসার আসনগুলো পলিথিন দিয়ে মোড়ানো। দেখে বুঝাই যায়- এগুলো অব্যবহৃত ও নতুন। বিষয়টিও এমন। ভারত থেকে পাওয়া উপহারে অ্যাম্বুলেন্স দুটি একদিনও ব্যবহার করা হয়নি। আর স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ পাওয়া অ্যাম্বুলেন্সটি সিলেট থেকে রোগী নিয়ে ঢাকায় গেছে মাত্র দুই বার।
এ ছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরকালে প্রটোকলে অংশ নিয়েছিলো অ্যাম্বুলেন্স।
জানা গেছে, লোকবল সংকটের জন্য অত্যাধুনিক আর দামি অ্যাম্বুলেন্স ৩টি পড়ে আছে অব্যবহৃত। আর অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ওসমানী হাসপাতালের আলাদা রাখার জায়গা বা গ্যারেজ নেই বলে এভাবে পড়ে আছে খোলা আকাশের নিচে। অ্যাম্বুলেন্সগুলো
এমন অবস্থায় থাকলেও এগুলোর ব্যবহারে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে হাসপতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, এই ৩টি বিশেষ অ্যাম্বুলেন্সের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা চিকিৎসক ও নার্স রাখার কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তাছাড়া এগুলো সুরক্ষিতভাবে রাখতে গ্যারেজের প্রয়োজন। তা নেই ওসমানী হাসপাতালে। আর নতুন করে গ্যারেজ তৈরির জন্য বর্তমানে হাসপাতালে কোনো বরাদ্দ নেই।
গাড়ি রাখা হয়। অ্যাম্বুলেন্স রাখার গ্যারেজ না থাকায় খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়েছে রোগী বহনের দামি গাড়িগুলো। এদিকে, আইসিইউ সুবিধাসংবলিত ৩টি অ্যাম্বুলেন্স সিলেটে আছে-এমন খবর অনেকেই জানেন না। অথচ আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকায় রোগী বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চাইতে খরচ ৫ গুণ কম হয়ে থাকে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, আগে বিশেষায়িত অ্যাম্বুলেন্সগুলো পরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ করা ছিল না। তবে কিছুদিন আগে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ অ্যাম্বুলেন্সগুলোতে রোগী পরিবহনের জন্য কিলোমিটারে ১০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। বেসরকারি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সে সিলেট থেকে ঢাকায় রোগী নিয়ে যেতে প্রায় ৫০ হাজার টাকা ভাড়া হলেও সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে সেটি পাঁচ হাজার টাকার মতো। কিন্তু এত সুবিধা থাকার পরও ফেলে রাখা হয়েছে অ্যাম্বুলেন্সগুলো।
অপরদিকে, ২০২১ সালে তৎকালিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট- আসনের এমপি ড. এ কে আব্দুল মোমেন সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে এক মতবিনিময় সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১০ হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। অনেকগুলোর বাক্সও খোলা হয়নি। বাকি সব নষ্ট হয়ে আছে।’ মন্ত্রীর এই বক্তব্য নিয়ে তখন সিলেটজুড়ে শুরু হয় তোলপাড়।
একই সভায়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গাফিলতিতে সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের জন্য বরাদ্দ দেওয়া ১০০ কোটি টাকা ফেরত যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘টাকা আনার পর কাজ না হওয়া খুবই দুঃখজনক। এর জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’