• ৯ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ২৬শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১১ই শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

শাহ আরেফিন টিলায় ৫ আগস্ট থেকে হরিলুট, নিরব ভূমিকায় প্রশাসন

bijoy71news
প্রকাশিত জানুয়ারি ৪, ২০২৫
শাহ আরেফিন টিলায় ৫ আগস্ট থেকে হরিলুট, নিরব ভূমিকায় প্রশাসন

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পাথর কোয়ারি শাহ আরেফিন টিলা ও শাহ আরেফিন(রা.) আসনে গর্ত খুঁড়ে এবং ড্রেজার মেশিন দ্বারা পাথর লুটপাট করা হচ্ছে, তারই ধারাবাহিকতায় মাজারের ভেতর থেকে এখন পাথর উত্তোলন চলছে। কবরস্থান মাঠ ও রাস্তা ধ্বংস করা হয়েছে, ঝুঁকিতে রয়েছে মসজিদ, সাতশত বছরের পুরাতন ‘শাহ আরেফিনের মাজারে চলছে ধ্বংস কাণ্ড।

হযরত শাহ জালাল (রা.) এর সফর সঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার একজন হযরত শাহ আরেফিন (রা.)। প্রায় সাত’শত বছর আগে তিনি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার জালিয়ারপাড় গ্রামের পাশে টিলায় বিশ্রামের জন্য আস্তানা গড়েছিলেন। সেই থেকে এই পাহাড়ি টিলার নাম হয়ে যায় শাহ আরেফিন টিলা। তিনি যে জায়গায় বসে বিশ্রাম নিয়েছিলেন সেই অংশে কালো পাথরের বিশাল বেড়িবাঁধ দিয়ে আস্তানা তৈরি করা হয়েছিল। সবার কাছে এটাকে শাহ আরেফিন(রা.) মাজার বলে পরিচিত লাভ করে। প্রতিবছর বড় পরিসরে আয়োজন করে ওরশ করাও হয়ে থাকে।

সরকারি ওয়াকফ্ এস্টেটে ইসি নং ১৭২১০ শাহ আরেফিন(রা.) ও বিন্দিয়া মাজার নামে নিবন্ধন করা হয়েছে। সাতশত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মাজারে এখন ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। আস্তানার চারপাশে কয়েকশ’ বছরের পুরাতন বেড়িবাঁধের কালো পাথরগুলো লুটপাট করা হয়েছে ইতিমধ্যে। মাজারে শত শত ফলজ বনজ ও ওষুধিগাছ সহ বনজ গাছ ইতোমধ্যে কর্তন করা হয়েছে। পাথর সন্ত্রাসীদের কবল থেকে রক্ষা পায়নি দুই’শত বছরের পুরাতন বটগাছও। এমন স্মৃতি বিজড়িত বট গাছটিও কেটে ফেলা হচ্ছে। মূল মাজারে গর্ত খুঁড়ে এখন পাথর উত্তোলনের হিড়িক চলছে। নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছে শাহ আরেফিন(রা.) এর স্মৃতিবিজড়িত এই স্থানকে।

প্রায় ৫০০ একর জায়গাজুড়ে শাহ আরেফিন টিলা এলাকার অবস্থান। আড়াই দশক আগেও এখানে উঁচু বড় আকারের দুটি টিলা ছিল। টিলায় মাটির নিচে স্তরে স্তরে ছিল ছোট-বড় অসংখ্য পাথর। তাই স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে স্থানটিকে ডাকতেন ‘পাথরের খনি’। চূড়া আর টিলার ভাঁজে ভাঁজে ছিল সবুজ গাছপালা। তবে একসময় স্থানটিতে চোখ পড়ে ‘পাথরখেকো’দের। ধীরে ধীরে সাবাড় হতে থাকে পাথর। সুউচ্চ টিলার জায়গায় এখন গভীর গর্ত। চক্রটি খোঁড়াখুঁড়ি করে টিলা দুটির অন্তত ৮৫ শতাংশ জায়গা থেকে পাথর আর মাটি লুট করে নিয়েছে।

ঐতিহ্যবাহী এই স্থানে পাথরখেকোদের লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ চললেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন প্রদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। পাথর লুটে কারা জড়িত, এমন কোনো তালিকাও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে নেই। এমনকি, ৫ আগস্টের পর লুটপাটের কারণে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা নির্ধারণে প্রশাসন কোনো জরিপ বা তালিকাও করেনি। স্থানীয়রা প্রশাসনকে বিষয়টি জানালেও কোন এক অজানা কারণে নিরব দর্শকের ভূমিকায় রয়েছেন তারা।

স্থানীয়দের দাবি বৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকলেও গত পাঁচ মাসে দুই কোয়ারি ও আশপাশ এলাকা থেকে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। লুটের এ ঘটনার নেপথ্যে রয়েছেন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত প্রভাবশালী কয়েক নেতা। পাথর লুটের ঘটনায় ইতোমধ্যে এক নেতার পদ স্থগিত করেছে দলটি। মামলা হয়েছে বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে।

বৈধভাবে উত্তোলন বন্ধ থাকলেও বিএনপির স্থানীয় কয়েকজন নেতার (বহিষ্কৃত) ছত্রচ্ছায়ায় চলছে লুট। ৫ আগস্টের পর পাথর লুটের সঙ্গে জড়িত থাকার সত্যতা পেয়ে কেন্দ্র থেকে জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহপরানের পদ স্থগিত করা হয়। ওই সময় লুটপাটে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে জেলা বিএনপির সাবেক কোষাধ্যক্ষ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের অপসারিত চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপন এবং পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্সের বিরুদ্ধে। পাথর লুটের ঘটনায় ওই তিন নেতাসহ ১১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। লুটের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে সোমবার জাফলংয়ে সংঘর্ষও হয়।

জানা যায়, ১৩৭ দশমিক ৫ একরের টিলার মধ্যে ১০ একর জায়গা শাহ আরেফিন(রা.) ও বিন্দিয়া মাজারের নামে ওয়াকফ্ করা। এই দশ একর জায়গায় মাজার, মসজিদ কবরস্থান ও একটি মাঠ ছিল। মাঠ ও কবরস্থান তিন মাসে পাথর উত্তোলন করে ইতোমধ্যে বিলীন করে দেয়া হয়েছে। ২ বছর থেকে মসজিদের কার্যক্রম ও নিয়মিত পরিচালিত হচ্ছে না। মসজিদের চারিদিকে পাথর উত্তোলন করায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সম্প্রতি গত চার মাস থেকে মাজারের মূল অংশে পাথর লুটপাট করা হচ্ছে। আর গত মাসেই শুধু মাজারের বেড়িবাঁধ থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকার পাথর লুটপাট করা হয়েছে। তাছাড়া মাজারের মূল অংশ থেকে প্রায় ৪০-৫০ ফুট গর্ত করে পাথর উত্তোলন চলছে। মাঠ মসজিদ ও কবরস্থান হয়ে মাজারে যাওয়ার রাস্তা বিলীন করে দেয়া হয়েছে। ফলে এখন মাজারের ভেতরে গর্ত খুঁড়ে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে আর এসব পাথর খেকোদের ছোবলে ধ্বংস করে প্রায় শত কোটি টাকার পাথর লুট করে নিয়েছে।

সরেজমিনে প্রত্যক্ষ ঘুরে দেখা যায়, একসময়ের উঁচু উঁচু পাহাড়ের মতো দেখতে টিলা গুলো এখন সমান্তরালে ড্রেজার মেশিন দ্বারা মাটি কেটে পাথর উত্তোলনের জন্য গর্ত খুঁড়ে পাথর বের করে নিতে একসময়ের উঁচু উঁচু পাহাড় টিলা ছিল তখনকার বাস্তবতার ক্ষেত্রে এখনকার সময়ে স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িছে। আর এসব দুর্ধর্ষ লুটপাটে বিলীন হয়ে গেছে উঁচু উঁচু পাহাড়ের টিলা ও মাজার। আর এসব দুর্ধর্ষ লুটপাটে জড়িয়ে রয়েছেন স্বয়ং শাহ আরেফিন(রা.) মাজারের খাদেমদের উত্তরাধিকারী আব্দুল মান্নান ফকিরের বংশধরেরা। আর এদের রয়েছে শক্তশালী একটি গোষ্ঠী। তাদের আত্মীয় স্বজনরা সেখানে পাথর লুটপাট করতে গড়ে তুলেছে সিন্ডিকেট আর সে সিন্ডিকেটে ১৯ সদস্য শক্তিশালী বাহিনী। এ বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছেন ১ নং ইসলামপুর ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের আওয়ামীলীগের সভাপতি আঃ রশিদ ও তার ভাই মনির মিয়া, ও যুবলীগের একই ওয়ার্ডের সভাপতি ফয়জুর রহমান, এবং জালিয়ারপাড় গ্রামের মৃত নঈম উল্লাহ্ ছেলে আঃ করিম, মৃত শুকুর আলীর ছেলে কালা মিয়া, মৃত আঃ খালিকের ছেলে বিএনপির নেতা বাবুল মিয়া সহ তাদের ১৯ সদস্যের একটি সিন্ডিকেট। তারা স্থানীয় প্রভাবশালী বলিয়ান লাঠিয়াল বাহিনী দ্বারা চলছে শাহ আরেফিন টিলার পাথর লুট। স্থানীয় প্রশাসনের পুলিশ ও বিজিবি কে ম্যানেজের দায়িত্ব পালন করছেন একই সিন্ডিকেটের মধ্যমনি যুবলীগ নেতা ফয়জুর রহমান ও আওয়ামীলীগের নেতা আঃ করিম এবং বিএনপির নেতা বাবুল মিয়া।

৯০-এর দশক থেকে শাহ আরেফিন টিলার মাজারের দেখবাল করে আসছেন মহিত শাহ ওরফে লালু শাহ। তিনি জানান, ২০০৭ সালের আগ পর্যন্ত আমার শাশুড়ি বেসরকারিভাবে এই মাজারের খাদিম ছিলেন। এর আগে তার বাবা, তার বাবার বাবা এভাবে ৬ প্রজন্ম পর্যন্ত উনারা খাদিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তারা প্রতি বছর মাঘ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ওরস করতেন। সাত সালের পর যখন পাথর উত্তোলন করে মাজার ধ্বংসের পায়তারা শুরু হয় তখন আমি সরকারি ওয়াকফ্ এস্টেট থেকে নিবন্ধন করি। এরপর ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমি মাজার সংরক্ষণ করে রাখতে পেরেছি। সে সময় মাজার রক্ষায় ডিসি, পরিবেশ, খনিজ মন্ত্রণালয়, এসপি, বেলা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে কোট ফি যুক্ত অভিযোগ দায়ের করি। যার কারণে কেউ মাজার থেকে পাথর উত্তোলন করার সাহস করেনি। পরবর্তীতে মাজারের জায়গা থেকে পাথর উত্তোলন করার জন্য ঢাকাতে গিয়ে নতুন একটি কমিটি গঠন করে নিয়ে আসা হয়। বিষয়টি নিয়ে আমি সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করলে মাজার কমিটির সকল কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। বর্তমানে মাজারকে নিশ্চিহ্ন করতে মাজারের বেড়িবাঁধের সকল পাথর লুটপাট করা হয়েছে। এই পাথরগুলো কয়েকশ বছরের পুরাতন ছিল। একেকটি পাথ ২০ কেজি থেকে প্রায় ১শ’ মন ওজনের ছিল। বড় বড় পাথরগুলো হেমার দিয়ে ভেঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মাজার ধ্বংসকারীরা জানিয়েছে এই মাজারের জন্য নাকি তারা টিলা লিজ আনতে পারছে না। তাই তারা মাজার ধ্বংস করতে শুরু করেছে। মাজার রক্ষায় আমি শীগ্রই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবাও লিখিত অভিযোগ দায়ের করবো।

স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমরা জালিয়ারপাড় গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েও আমরা মাজার রক্ষার জন্য চেষ্টা করছি কিন্তু পারতেছিনা। ইতোপূর্বে মাঠ ও কবরস্থান রক্ষার কথা বলায় আমরা তাদের দুষমনে পরিনত, এমনকি হুমকি ধামকি হামলা মামলার শিকার হয়েছি। বর্তমান পরিস্থিতি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছি তারা কোন প্রদক্ষেপ নিচ্ছে না। আমরা গ্রামের পক্ষ থেকে মাজার রক্ষায় আইনী প্রদক্ষেপ নিব।

সর্বশেষ ওয়াকফ্ এস্টেট কর্তৃক কমিটির সভাপতি মো. আনোয়ার আলী (আনাই) বলেন, গত দুই আড়াই বছর আগে আমার কমিটি বিলুপ্ত হয়েছে। নতুন করে আর কোন কমিটি করা হয়নি। যারা আমার সাথে কমিটিতে ছিল তাদেরকেও ডাকলে পাওয়া যায় না। মাঠ কবরস্থান ও মাজার রক্ষার জন্য আমি জালিয়ারপাড়ের মুরব্বিদের সাথে নিয়ে বার বার চেষ্টা করেও কোন লাভ হচ্ছে না। মাজার রক্ষায় আমরা এখন আইনি প্রদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তা করছি।

খান বাহাদুর এহিয়া ওয়াকফ এস্টেটের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ইসলাম উদ্দিনের যোগাযোগ করলে তিনি জানান, মাজার ধ্বংসের বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। আমাদের শাহ আরেফিনের মাজার ও ওয়াকফের জায়গা রক্ষায় আমার প্রদক্ষেপ নিব। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আমি দেখছি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাথর ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, পুলিশ ক্যাম্প বসানোর পর নির্বিচার পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়েছে। তবে রাতের অন্ধকারে পুলিশকে ম্যানেজ করে এখনো পাথর ও মাটি উত্তোলন চলছে। এ জন্য ট্রাক্টর ও ট্রলিতে থাকা পাথরের পরিমাণ অনুযায়ী গড়ে ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত পুলিশকে ঘুষ দিতে হয়।

তবে পুলিশের ম্যানেজ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ। তিনি বলেন, কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সিলেট জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) কে ফোন দিয়ে শাহ আরেফিন মাজার ধ্বংস করে পাথরখেকোরা গর্ত খুঁড়ে পাথর লুট করে নেওয়ার বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন খোঁজ নিয়ে জানাবেন।

সিলেটের জেলা প্রশাসক (ডিসি) সঙ্গে সরকারি মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সম্প্রতি আমি কোম্পানীগঞ্জ পরিদর্শন করে এসেছি। শাহ আরেফিন টিলা মাজার নিয়ে এমন হচ্ছে কেউ বলেনি। তবে, এখন মাত্র জানতে পারলাম, আমি শাহ আরেফিন টিলা মাজার নিয়ে জেনে নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবো।