নিজস্ব প্রতিবেদক :: গ্রামের মানুষকে করোনার টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিলেও সিলেটে সেদিকে লক্ষ্য নেই কর্তৃপক্ষের। বরং নগর, উপজেলা সদর আর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স লাগোয়া মানুষদের টানতেই মনযোগী কর্তৃপক্ষ। আর এতে শহর এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর আশপাশ এলাকার মানুষের মাঝে করোনার টিকা নিতে আগ্রহ বাড়লেও অনেকটা বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষ। প্রচার প্রচারণার অভাব কিংবা অতিরিক্ত দূরত্বের কারণে ইচ্ছা থাকলেও টিকা নিতে আগ্রহী হচ্ছে না সাধারণ মানুষ।
সিলেট জেলায় মোট ১৩ টি উপজেলা হলেও করোনার টিকা কার্যক্রমের আওতায় ধরা হয়েছে মোট ১২ টি উপজেলা। আর জেলার ওসমানীনগর ও বালাগঞ্জ মিলে ধরা হয়েছে এক উপজেলা। সব মিলে উপজেলার প্রতিটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মোট ২ টি করে বুথ দিয়ে চলছে টিকা কার্যক্রম। কিন্ত আয়তনের দিক থেকে অধিক বড় এসব উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স লাগোয়া নাগরিকরা টিকা নিতে পারলেও ইচ্ছা থাকলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষ টিকা নিতে আসতে পারছেন না। এমনকি টিকা গ্রহীতাদের মধ্যে নারীদের সংখ্যাও কম।
বৃহস্পতিবার টিকা কার্যক্রমের ৫ম দিন আমাদের সিলেট জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রতিনিধিরা সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত টিকাদান বুথগুলো সরেজমিন করে জানিয়েছেন, যোগাযোগের দুরবস্থা, অতিরিক্ত খরচসহ নানাবিধ কারণে টিকা ঠেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। সেই সাথে আছে প্রচারণা ও সচেতনতার অভাব। এ ক্ষেত্রে টিকা কার্যক্রম কেবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সীমাবদ্ধ না রেখে ইউনিয়ন পর্যায় কিংবা ক্রমান্বয়ে ওয়ার্ড পর্যায় প্রসারিত করতে পারলে সকল শ্রেণির মানুষের টিকা নিতে পারবে বলে মত স্থানীয়দের।
এদিকে বৃহস্পতিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) গাজীপুরের সফিপুরে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর (ভিডিপি) ৪১তম জাতীয় সমাবেশ ও কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘গ্রামের মানুষকে ভ্যাকসিন নিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অনেকে ভয় পায়, সুঁই ফোটাতেও ভয় পায়। সে ক্ষেত্রে তাদের ভ্যাকসিন নিতে সাহস যোগাতে হবে। আমরা চাই, সবাই টিকা নিক, সুরক্ষিত থাকুক। দেশের মানুষ যাতে এই মহামারি থেকে মুক্তি পায় তার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’
প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনা থাকলেও সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলায় কোন টিকা বুথই স্থাপন করা হয়নি। টিকার জন্য কোন বুথ না থাকায় ওই এলাকার লোকজন পড়েছেন বিড়ম্বনায়।
সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার ৫ নং গোয়ালাবাজার ইউপির ৫ নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. জিলু মিয়া। অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরের পথ পাড়িয়ে দিয়ে করোনার টিকা নিতে গিয়েছিলে বালাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সকাল গেলেও টিকা নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে হয়েছে সন্ধ্যা। কিন্তু তিনি নিজে টিকা নিলেও নিজের ওয়ার্ডের আর কেউ নিতে পারছেন না টিকা। সে ক্ষেত্রে অনেকটা ক্ষুব্ধ মো. জিলু মিয়া বলেন, আমার ওয়ার্ড থেকে বালাগঞ্জের দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। আর সিলেট শহরের দূরত্ব মাত্র ২০ থেকে ২২ কিলোমিটার হবে। তাহলে তো সিলেট শহরে হলেই ভালো ছিলো।
তিনি আরও বলেন, এতো দূরে গিয়ে মানুষ টিকা দিবে কি ভাবে। যাদের টাকা আছে বা তুলনামূলক সচেতন, তারা না হয় গেলো টিকা দিতে। কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষরা তো যাবে না। তার ওপর করোনার টিকা নিয়ে শুরুতে নানা গুজব থাকার কারণে সাধারণ মানুষের মাঝে একধরণের ভয় এখনো আছে। তাই অন্তত ইউনিয়ন পর্যায় একটি করে বুথ রাখা উচিৎ ছিলো। আর না হোক অন্তত অন্যান্য উপজেলার মত ওসমানীনগর উপজেলায় বিকল্প ভাবে বুথ রাখা প্রয়োজন।
অপরদিকে সিলেটের সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, সিলেট জেলার জন্য মোট ১৬৩ টি করোনার টিকা বুথ রাখা হলেও চালু আছে মাত্র ৪১ টি। হিসেব অনুযায়ী সিএমচএইচ জালালাবাদ হাসপাতালে ৪ টি, সকল উপজেলায় ৩ টি করে ৩৬, জেলার প্রতিটি ইউনিয়নের জন্য একটি করে ১০০ টি বুথ, পুলিশ হাসপাতালের জন্য ১ টি বুথ, ওসমানী মেডিকেল এবং সদর হাসপাতাল মিলে ১২ টি বুথ, এবং সিভিল সার্জন অফিসে অতিরিক্ত ২ টি, সিসিকের অতিরিক্ত ১০ টি বুথ মিলে মোট ১৬৩ টি বুথের অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু এসব বুথের মধ্যে এখন চালু আছে মাত্র ৪১ টি বুথ।
চালু থাকা বুথগুলোর মধ্যে সকল উপজেলায় ২ টি করে ২৪ টি (ওসমানীনগর উপজেলা ছাড়া), সিএমআইচ জালালাবাদ হাসপাতালে ৪টি, ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২ টি আর পুলিশ হাসপাতালে ১ টি।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেটের উপ পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান জানান- বৃহস্পতিবার সিলেট জেলার ১২ উপজেলার ২৪টি বুথ ও সিএমএইচের চারটি বুথে করোনা টিকা গ্রহণ করেছেন মোট ১৪৭৩ জন।
এদিকে প্রথম দিনের সেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে এখন প্রতিনিয়ত বাড়ছে করোনা টিকা গ্রহীতার সংখ্যা। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে- গত ৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম দিন সিলেট জেলায় করোনা টিকা গ্রহণ করেছিলেন ৯৪৮ জন। দ্বিতীয় দিনে টিকা নেন ১৭৪৮ জন। তৃতীয় দিন ২৯৬৪ জন এ টিকা গ্রহণ করেন। চতুর্থ দিনে টিকা নেন ৪৭৫৭ জন এবং পঞ্চম দিনে এসে টিকা গ্রহণ করেছেন ৫৫৪৮ জন। সব মিলিয়ে সিলেট জেলায় টিকা গ্রহীতার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯৬৫ জনে।
তবে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে বুথের অনুমোদন থাকলেও এখনো মন্ত্রণালয়ের কোন নির্দেশনা পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. প্রেমানন্দ মণ্ডল।
অপরদিকে সিলেট নগরেও মধ্যম আয়ের কিংবা উচ্চ আয়ের সচেতন মানুষের মাঝে টিকা নিতে বেশ আগ্রহ থাকলেও নিম্ন আয়ের মানুষদের টানতে পারছেন কর্তৃপক্ষ।
তবে সকল শ্রেণির মানুষদের সম্পৃক্ত করতে বিকল্প পথে এগোচ্ছে সিসিক। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের বাসিন্দাদের জন্য আলাদা ৩ টি রেজিস্ট্রেশন বুথ চালু করেছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন। এর মধ্যে সিটি কর্পোরেশন ভবনের অভ্যন্তরে ২ টি অনলাইন রেজিস্ট্রেশন বুথ ও ওসমানী মেডিকেল অভ্যন্তরে চালু করা হয়েছে একটি বুথ।
সিটি কর্পোরেশন অভ্যন্তরে স্থাপন করা দুই বুথে অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যাবে আর ওসমানী মেডিকেল কলেজ অভ্যন্তরে সিসিকের স্থাপন করা বুথে ৪০ ঊর্ধ্ব যে কোন ব্যক্তি জাতীয় পরিচয়পত্র সাথে নিয়ে গিয়ে ফরম পূরণের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করে টিকা দিতে পারবেন বলে জানিয়েছেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, যাদের জন্ম ১৯৮০ সালে বা তার আগে তাদের যে কেউ জাতীয় পরিচয়পত্র সাথে নিয়ে এসব বুথে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন।
ওয়ার্ড পর্যায় টিকাদান কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে কি কোন পরিকল্পনা নিয়েছেন এমন প্রশ্নে ডা. জাহিদুল ইসলাম বলেন, প্রতিটি ওয়ার্ডেও করোনার টিকা রেজিস্ট্রেশনের বিষয়টিও চিন্তা ভাবনা আছে। আমাদের ইচ্ছা ছিলো ওয়ার্ড পর্যায় আলাদা আলাদা রেজিস্ট্রেশন বুথ চালু করে মাইকে প্রচারণা করব। কিন্তু আমার করোনা শনাক্ত হওয়ায় এখন একটু সমস্যায় পড়ে গেছি। তবে এটা আমরা করব।