নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণায় বিলম্ব, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়ের করা রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারসহ বেশ কিছু ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
দলটির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে উপদেষ্টাদের কিছু মন্তব্য এবং সরকার-সমর্থিত একটি রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে বিএনপির আশঙ্কা দূরত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। দুই পক্ষের ব্যবধান কমাতে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সংলাপের আহ্বান জানিয়ে আসছে বিএনপি।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেদের অসন্তুষ্টির কথা জানাচ্ছেন বিএনপির নেতারা।
দলটির নেতারা বলছেন, তারা সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়া নিয়ে খুশি নয়। তারা মনে করেছেন, নতুন এই অধ্যাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
সেই সঙ্গে তারা এটাও বলছেন সরকার একটি পরিষ্কার নির্বাচনী রোডম্যাপ নির্ধারণ এবং সংস্কারের জন্য সময়সীমা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ১৭ বছর নির্ধারণের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মন্তব্য নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছে দলটি। নেতারা বলছেন, এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নির্বাচনকে আরও পিছিয়ে দিতে পারে।
সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনের কবে হবে সে ব্যাপারে স্পষ্ট রোডম্যান না থাকায় হতাশ হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
অনেকটা অভিযোগের সুরে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়া বিলম্বিত করছে বলে জনমনে ধারণা তৈরি হচ্ছে।
ফখরুল বলেন, ‘সংস্কার কোন নতুন ধারণা নয়, কেউ যদি দাবি করে আমরা সংস্কার নিয়ে আসছি, এটা ভুল। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সেজন্য তো নির্বাচন বন্ধ হয়ে থাকতে পারে না। দিনের পর দিন একটি অনির্বাচিত সরকার হাতে দেশ চালাতে দিতে পারি না।’
গত ২৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ে এক জনসভায় ফখরুল বলেন, খাবার ও ভোটের অধিকারের জন্য জনগণকে আবারও রাজপথে নামতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আগামী নির্বাচন, তবে এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা মামলা নিয়েও অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনায় মুখর হচ্ছেন বিএনপির নেতারা।
ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করা হলেও খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো অমীমাংসিত রয়ে গেছে বলে উল্লেখ করেছেন বিএনপির একাধিক নেতা।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল দাবি করেছেন যে, অন্তর্বর্তী সরকার নিজেই রাজনৈতিক খেলায় অংশ নিচ্ছে।
দলটি এ কারণেও উদ্বিগ্ন যে অন্তর্বর্তী সরকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনকে সমর্থন করতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনকে সব সময়ই স্বাগত জানাই, তবে সরকারি সমর্থন নিয়ে দল তৈরি করা উচিত নয়।
তিনি আরও বলেন, ‘উপদেষ্টা হয়ে আপনি সরকারের মধ্যে থেকে রাজনীতি করেন। আর আপনি একটি দল গঠন করবেন এবং এর দোহাই দিয়ে সময় নষ্ট করবেন এবং নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত অজুহাত দিতে থাকবেন। জনগণ বোঝে যে আপনি কী করছেন।’
গত বছরের ২১ ডিসেম্বর বিএনপি সমমনা দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। সেখানে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে সরকারের সম্ভাব্য সম্পৃক্ততার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
সম্প্রতি মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এবং সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের মন্তব্যেরও সমালোচনা করেছে দলটি। অতীতে রাজনীতিবিদরা সংস্কারে ব্যর্থ হয়েছিল বলে সম্প্রতি এই দুই উপদেষ্টা মন্তব্য করেন।
জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ ও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি নিয়েও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের ওপর বিরক্ত বিএনপি।
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, মির্জা ফখরুল গত রোববার অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেন। তিন বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে এই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হলে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে।
গণঅভ্যুত্থান সংক্রান্ত যেকোনো কিছুতে ‘ঘোষণাপত্র’ না দেওয়ার পক্ষে বিএনপি। শুধু জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান নয়, গত ১৬ বছরে সংগ্রাম ও ত্যাগের স্বীকৃতি দিতে দলের শীর্ষ নেতারা এমন ঘোষণা চান।
দলটির নেতাদের মতে, এ বছরই আগামী নির্বাচন নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর বিএনপি।