আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গ্যাস সংযোগের জন্য রাস্তা কাটার অনুমতি পেতে ২০ কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন। তিনি বলেছেন, ‘শিল্প কারখানায় বিনিয়োগের পর গ্যাস পেতে নিজের টাকায় ৪০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করতে হয়েছে। এই পাইপলাইন নির্মাণে রাস্তা কাটা বাবদ ২০ কোটি ফি দিয়েছি। এর বাইরে আরও অতিরিক্ত অনেক টাকা দিতে হয়েছে।’
শনিবার (২৩ নভেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে শিল্প খাতে জ্বালানি সংকট নিয়ে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির এক আলোচনা সভায় বাণিজ্য উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগের সীমাহীন দুর্ভোগের চিত্র আর তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেন।
বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন বলেছেন, ‘শিল্প প্রতিষ্টান তৈরিতে অনেক বিনিয়োগের পর গ্যাস সংযোগ পাচ্ছিলাম না। গ্যাস পেতে সাবেক জ্বালানিমন্ত্রীর (প্রতিমন্ত্রীর) কাছে গিয়েছিলাম। সে সময় ওনার বাসার সামনে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম, যেন আমি কোনো চাকরি চাইতে গিয়েছি।
তিনি বলেন, ‘গ্যাস সংযোগ পাওয়া আমার কাছে মনে হতো ব্যাংকের নিবন্ধন পাওয়ার মতো। যা হোক, বৃষ্টিতে ভিজে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়। এরপর ওনার সঙ্গে বসে অনেক লেকচার শুনেছি। কিন্তু সেসব কথা মানতে পারিনি; নিজের জ্ঞানের সঙ্গে মেলাতে পারিনি। তারপরও চেষ্টা করেছি শুনে যেতে। কারণ, কিছুই করার ছিল না। ব্যবসায়ী হিসেবে ন্যুনতম যে মর্যাদা প্রত্যাশা করি, তা তখন পাইনি। তারপরও জ্বি স্যার, জ্বি স্যার বলতে হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, একটা নির্দিষ্ট দূরুত্বের বাইরে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে এই ফিস দিতে হয়। তবে অতিরিক্ত এই ফিস নিয়েও ব্যবসায়ী ও সাধারন মানুষের দীর্ঘদিনের আপত্তি রয়েছে।
অনুষ্ঠানে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি জ্বালানি উপদেষ্টাকে এক মিটিংয়ে বলতে শুনেছি— জ্বালানি খাত দুর্নীতির অন্যতম স্তম্ভ। সেখান থেকে আমাদের বের হতে হবে।’
সেখ বশিরউদ্দিন বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও জ্বালানি খাতে দেশ নৈরাজ্যের চরম সীমায় পৌঁছেছিল। সে সময় ব্যবসায়ীদেরও কোনো মর্যাদা ছিল না। তবে এখন সে পরিস্থিতি বদলেছে।
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘এখন আপনাদের যথাযথ মর্যাদার পরিবেশ রয়েছে। আপনারা এগিয়ে আসুন। সব কাজ সরকার একা করে দিতে পারবে না। নিজেদের টাকা নিজেদের জন্য নিজেরা ব্যয় করুন। অতীতে (প্রভাবশালীদের) এত টাকা দিয়েছি, তার হিসাবও করতে পারব না। এখন আর কাউকে তো টাকা দিতে হবে না। নিজেরাই নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে পারবেন। এখন সুযোগ এসেছে, এ সুযোগ ব্যবহার করুন।’
সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেশ নৈরাজ্যের চরম সীমায় পৌঁছেছিল বলেও মন্তব্য করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘বিগত সময়ে এ দেশে এমন এক বিচারহীনতা, ক্রনিক্যাপিটালিস্ট (স্বজনতোষী) ও একপেশে পরিবেশের মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছিলাম, যেখানে আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা ছিল না।’
বশিরউদ্দিন আরও বলেন, ‘আমাদের মেপে কথা বলতে হয়েছে, অনিচ্ছা সত্তে¡ও নিজের মস্তিষ্ককে অসম্ভব চাপ দিয়ে (প্রভাবশালীদের) স্তুতি করতে হয়েছে। এমন সব ন্যারেটিভ (বর্ণনা) শুনতে হয়েছে এবং বিশ্বাস করতে হয়েছে, যা শোনার পরে নিজেকে আহত করতে ইচ্ছা হয়েছে। নিজের অর্জিত জ্ঞানকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।’
জ্বালানি খাতকে দুর্নীতির অন্যতম জায়গা উল্লেখ করে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পরে কিছু আর্থিক অপরাধী সম্পর্কে জানতে পারছি। এসব জেনে আমার কিছু কিছু মানুষের ব্রেন স্ক্যান করে দেখতে ইচ্ছা করে যে এরা এতটা ক্রিমিনাল কী করে হতে পারে?’
‘জ্বালানি খাতের বর্তমানে যে দুর্বলতা রয়েছে তা কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি পরিকল্পনা (ডিজাইন) করে করা হয়েছে। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে বাস্তবতাকে অস্বীকার করার প্রবণতা নেই। সুতরাং আমরা বিদ্যমান সমস্যার সম্ভাব্য সমাধানের দিকেও যেতে পারব বলে আশা করছি।’ এ জন্য ব্যবসায়ী মহলের সহযোগিতা চান তিনি।