গণহত্যাকারী আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেব না মানে আইন নিজের হাতে তুলে নেব না বলে জানিয়েছেন, জামায়াত আমীর জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।
তিনি বলেছেন, ‘বিগত সরকার ক্ষমতার লোভে জেদের বশবর্তী হয়ে সুস্পষ্ট গণহত্যা চালিয়েছে। সরকার শুধু স্থলভাগেই নয়, আকাশ থেকেও গুলি চালিয়ে নিজ দেশের নাগরিকদের হত্যা করেছে। স্বাধীন দেশে পরিচালিত এই গণহত্যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা বর্তমান সরকারের কাছে দাবি জানাই খুনিদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
শফিকুর রহমান আরও বলেন, ‘দল হিসেবে সাড়ে ১৫ বছর পরে আমাদের সাথে বৈরী আচরণ করা হয়েছে। আমাদের নিবন্ধন কেড়ে নেয়া হয়েছে। শেষ মুহূর্তে সরকার দিশেহারা হয়ে আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছে। আমরা বলেছি আমরা প্রতিশোধ নেব না, এর মানে হচ্ছে আমরা নিজের হাতে আইন তুলে নেব না। কিন্তু যিনি সুনির্দিষ্ট অপরাধ করেছেন তার বিরুদ্ধে মামলা হবে এবং তাকে শাস্তি পেতে হবে। গণহত্যার বিচার করতে হবে এবং গত সাড়ে ১৫ বছরে যেসব অপরাধ করা হয়েছে তার বিচার করতে হবে।’
বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) ঢাকার মগবাজারস্থ আল-ফালাহ মিলনায়তনে দলটির কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার অধিবেশনে তিনি এসব কথা বলেন।
দলের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের পরিচালনায় নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের ও মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ ও কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এসময় জামায়াত আমির আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি ক্ষতিগ্রস্ত যারাই মামলা করবেন, আইনের আশ্রয় নিবেন, কোনো মানুষের ওপর যেন বেইনসাফি না হয় সেদিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতে হবে। কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে যেন আসামি করা না হয়।’
শফিকুর রহমান বলেন, ‘দেশটা আমাদের সবার। ছাত্রদের আন্দোলনে আপামর জনতা অংশ নিয়েছে। এ আন্দোলনের সকল রাজনৈতিক দল, শ্রেণি-পেশার মানুষ শরিক হয়েছে। প্রবাসী ভাইয়েরাও দেশবাসীর সাথে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। আন্দোলন করতে গিয়ে তারা নিগৃহের শিকার হয়েছে। একটি দেশে ৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করে আজীবন শাস্তি দেওয়া হয়েছে। আমরা সরকারকে দাবি জানিয়েছিলাম তাদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছাড়িয়ে আনতে হবে। আমরা এ সরকারকে ধন্যবাদ জানাই যে, তারা উদ্যোগ নিয়েছেন এবং ওই দেশের সরকারকেও ধন্যবাদ জানাই তারা আন্দোলনকারীদের ক্ষমা করে মুক্তি দিয়েছে। আমরা সরকারের কাছে দাবি করছি তাদেরকে মর্যাদাপূর্ণভাবে পুনর্বাসন করতে হবে।’
জামায়াত আমির আরও বলেন, ‘দেশের কিছু চতুর ধনী মানুষ জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে ব্যাংকগুলো ফোকলা করে দেশের বাইরে অর্থ নিয়ে গেছেন। এ অর্থ আমাদের সবার। এ অর্থ ১৮ কোটি মানুষের। এ অর্থ ফিরিয়ে আনতে হবে এবং লুণ্ঠনকারীরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক তাদেরকে ফিরিয়ে এনে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এরা জাতির দুশমন, এরা লুটেরা। এদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে। আজকে সময় এসেছে বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার। অন্যায়, অসত্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে হবে।’
জাতির এই কাঙ্খিত পরিবর্তনকে কেউ যাতে ব্যর্থ করে না দিতে পারে এজন্য সকলে মিলে আমরা পাহারাদারী করব উল্লেখ করে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘স্বাধীনতার পক্ষে আমাদেরকে আপসহীন অবস্থান নিতে হবে। আল্লাহ বাংলাদেশের ওপর রহমত নাজিল করুন। একটি সভ্য ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনে আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।’
ইসলামের জন্য আন্দোলন করায় হত্যা-জুলুম করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘কেবল ইসলামী আন্দোলন করার কারণে তাদের ওপর জুলুম করা হয়েছে। আমাদের মধ্য থেকে ১১ জন নেতৃবৃন্দকে অন্যায়ভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। পাঁচজনকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সাজানো মামলায় মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ফাঁসির মঞ্চে হত্যা করা হয়েছে। পাঁচজন ইন্তেকাল করেছেন জেলের মধ্যে। একজনকে হাসপাতালে ভর্তি করে সুস্থ করার পরিবর্তে তার লাশ কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার জানাজায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হামলা চালিয়েছে। যাদেরকে সরকার অবৈধভাবে ফাঁসি দিয়েছে তাদের একজনের জানাজাও শান্তিমত করতে দেয়নি। শহীদ নেতৃবৃন্দের বাসা-বাড়িতে হামলা করা হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। এই ভীতিকর পরিস্থিতে অনেকে নিজের বাড়িতে অবস্থান করতে পারেনি। শহীদ পরিবারের কোনো কোনো সদস্যকে গুম করা হয়েছে। গুমের শিকার দুইজন মুক্ত হয়ে দেশবাসীকে তাদের ওপর চালানো অমানবিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। আয়নাঘর নামক এক ধরনের গ্যাস চেম্বারে তাদেরকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলে, যেখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। আমাদের মা-বোনদেরকেও বেইজ্জত করতে কুষ্ঠাবোধ করেনি।’
শফিকুর রহমান বলেন, ‘গত জুলাই মাসে ছাত্ররা তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ কয়েকজন মন্ত্রী উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে ছাত্র আন্দোলন দমনের অপচেষ্টা করে। মা তার দেড় মাসের শিশুকে কোলে নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। শিশু থেকে শুরু করে নব্বই বছরের বয়স্ক মানুষও ছাত্রদের আন্দোলনে শামিল হন। হাজারো ছাত্র-জনতার প্রাণ বিসর্জনের মাধ্যমে দেশের ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী আমরা তাদেরকে স্মরণ করছি, যাদের তাজা রক্তের বিনিময়ে আমরা শান্তি-স্বস্তির পরিবেশে কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার এই অধিবেশন করতে পেরেছি। তারা জাতিকে স্বস্তির নিঃশ্বাস এনে দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে দুই জায়গায় মর্যাদা দান করুন।’
‘যারা আন্দোলনে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন আল্লাহ তাদেরকে শাহাদাতের মর্যাদা দান করুন। আল্লাহ তায়ালা তাদের পরিবারগুলোকে এই শোক বহন করার তৌফিক দান করুন, তাদেরকে উত্তম সবর করার তৌফিক দান করুন। যারা আহত হয়েছেন তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা সুস্থতার নিয়ামত দান করুন’ বলেন ডা. শফিকুর।
তিনি আরও বলেন, ‘হিটলারের গ্যাস চেম্বারের মতো আমাদের দেশে আয়নাঘর তৈরি করা হয়েছে। শুধু জামায়াতে ইসলামী নয় বিরোধীদল বিএনপি, উলামায়ে কেরামসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের ওপর একই ধরনের তাণ্ডব চালানো হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর ওপর ভিন্ন মাত্রায় তাণ্ডব চালানো হয়েছে। হাজার হাজার আলেমকে যেনতেন অযুহাতে গ্রেপ্তার করে বছরের পর বছর কারাগারে বন্দী রাখা হয়েছিল। বয়স্ক আলেমদেরকেও হাতে পায়ে বেড়ি পরিয়ে আদালতে তোলা হয়েছিল। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েই জালিমরা ক্ষ্যান্ত হয়নি বরং আলেমদেরকে মুখ না খুলতে হুমকি দেওয়া হয়েছে। বিগত সরকারের দুঃশাসনের সাড়ে ১৫ বছর আমাদেরকে রাস্তায় নামতে দেয়া হয়নি। মিছিল-মিটিং নিষিদ্ধ করায় সরকারের অকথ্য জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদও আমরা করতে পারিনি। ফ্যাসিস্ট সরকার তিনটি অগ্রহণযোগ্য প্রহসনের নির্বাচনের আয়োজন করেছে।’
‘গুম, খুন, হত্যা, মামলা-হামলা, গ্রেফতার, নির্যাতন, লুণ্ঠন, দখলদারী, ধর্ষণসহ নানা অপরাধ যখন চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করে, তখন জমিনে আল্লাহ তায়ালার ফয়সালা নেমে আসে’ বলেও মন্তব্য করেন জামায়াতের আমির।