• ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

খেলাপি ঋণের তথ্য চাপা দিতে বেশি তৎপর বাংলাদেশ ব্যাংক

bijoy71news
প্রকাশিত অক্টোবর ৩, ২০২৩
খেলাপি ঋণের তথ্য চাপা দিতে বেশি তৎপর বাংলাদেশ ব্যাংক

ব্যাংকখাতের ক্যান্সার বলে আখ্যায়িত খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক এপ্রিল-জুনে মাত্র তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। খেলাপি ঋণ যত বাড়ছে তথ্য লুকোচুরিতে তার চেয়েও বেশি তৎপরতা বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সাধারণত এক প্রান্তিকের তথ্য এক মাসের মধ্যেই প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এবার খেলাপির দ্বিতীয় প্রান্তিকের তথ্য প্রকাশে তৃতীয় প্রান্তিক শেষ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি, কয়েকটি ব্যাংকের তথ্যে গড়মিল থাকায় সমন্বয় করতে দেরি হয়েছে।

বাংলাদেশের মুদ্রাবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকা ব্যাংকখাতের খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বিগ্ন সংস্থাটি। সংশ্লিষ্ট এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তেবলেন, ‘যেভাবে খেলাপি ঋণ বাড়ছে তা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কীভাবে খেলাপি কমানো যায় তা নিয়েও কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব তথ্য প্রকাশ হলে ব্যাংকখাতে একটি অস্থিরতা তৈরি হয়। সাধারণ জনগণের মধ্যে আস্থাহীনতা কাজ করে। তাই এসব তথ্য যেন প্রকাশিত না হয় সে ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।’

বিশেষ ব্যবস্থা কী জানতে চাইলে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি। তবে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকখাতের নেগেটিভ নিউজ (নেতিবাচক সংবাদ) অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে, যা দেশের জন্য ভালো হবে না। এমনিতেই অর্থনীতিতে একটি সংকট পার করছে দেশ। এ অবস্থায় দেশের ভালোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু তথ্য চেপে গেলেও সেটা দোষের কিছু নয়।’ তবে অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, তথ্য চাপা দিয়ে ভালো কিছু করা যায় না। এতে সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য কর্মকর্তা ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ব্যাংকখাতের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো খেলাপি ঋণ। মাত্র তিন মাসে ২৪ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে খেলাপি। এ হার আরও বাড়তো যদি না সুযোগ দেওয়া হতো নতুন করে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন দিয়ে ঋণ পরিশোধে ছাড় দেয়। ৫০ শতাংশ টাকা পরিশোধ করলেই নিয়মিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যার ফলে খেলাপি ঋণ আরও ৫০ শতাংশ কম হয়েছে। নইলে আরও বেশি হতো।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে খেলাপি ঋণের হার ২৩ থেকে ২৪ শতাংশ। এগুলো আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। প্রকৃত তথ্য সামনে না এলে সঠিক সমাধান করা যাবে না। চিকিৎসক যদি সঠিক রোগ নির্ণয় করতে না পারে তবে কোনো চিকিৎসা দিয়েই রোগী সুস্থ হবে না।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য প্রকাশে গড়িমসি নিয়ে তিনি বলেন, ‘তথ্য কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ হয়েই যাবে। এতে করে সংস্থাটি আরও অস্বস্তিতে পড়বে। এর চেয়ে বরং কীভাবে খেলাপি কমানো যায় সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে।’

তথ্য প্রকাশ না করার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থা হয়তো মনে করছে এতে করে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। এভাবে তথ্য প্রকাশে গড়িমসি না করে খেলাপি কমাতে যদি ভালো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাবমূর্তি আরও বাড়বে।’

তথ্য প্রকাশে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো বাধা নেই বলে জানান সহকারী মুখপাত্র সারোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘এবারের প্রান্তিকে তথ্য প্রকাশে দেরি হয়েছে ঠিক। তবে সঠিক তথ্য প্রকাশের কারণে সময় বেশি লেগেছে। আমাদের কাছে কয়েকটি ব্যাংক ভুল তথ্য দিয়েছিল বলে প্রতীয়মান হওয়ায় সেসব তথ্য আবার আনা হয়েছে। সেগুলো সমন্বয় করে, যাচাই-বাছাই করতে সময় বেশি লেগেছে। এছাড়া অন্যকিছু নয়।’

বাংলাদেশ ব্যাংক তথ্য প্রকাশে কড়াকড়ি আরোপ করেছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘আমরা আরও আগেই সবকিছু তৈরি করে গভর্নর বরাবর পাঠিয়েছি। তিনি যেদিন স্বাক্ষর করবেন সেদিনই তথ্য অফিসিয়ালি পূর্ণতা পাবে। আমাদের এর চেয়ে বেশি কিছু করার নেই। এছাড়া আমাদেরকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন বেশ কয়েকবার সাংবাদিকদের তথ্য প্রদান থেকে বিরত থাকতে। কারও বিরুদ্ধে তথ্য প্রদানের প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তির পাশাপাশি চাকরিচ্যুতির হুমকিও দেওয়া হয়েছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্যমতে, এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাসে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা বেড়েছে খেলাপি ঋণ। প্রান্তিকের আগে ঋণগ্রহণকারীদের সুবিধা দিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেখানে বলা হয়, কিস্তির ৫০ শতাংশ পরিশোধ করলেই কোনো গ্রাহক খেলাপি হবেন না।

এ সুবিধা দিয়েও খেলাপি কমাতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বরং গেল কয়েকবছরের মধ্যে এবারই খেলাপি ঋণ এক প্রান্তিকে ২৪ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। এর আগে করোনা মহামারিতে ব্যাপক ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিস্তির মাত্র ২ শতাংশ পরিশোধেই ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ পেয়েও অনেক গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করেননি। এই সুযোগ বিভিন্ন ধাপে ২০২২ সালের শেষ পর্যন্ত বহাল রাখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি বছরের শুরুতে কিস্তি পরিশোধের সুবিধা বাতিল করে দেয় সংস্থাটি। এর ফলে প্রথম প্রান্তিক জানুয়ারি থেকে মার্চে খেলাপি বাড়ে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু দ্বিতীয় প্রান্তিকে এসে রেকর্ড পরিমাণ বাড়লো খেলাপি ঋণের পরিমাণ।