ব্যাপক বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোর বহু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে ১৮ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে সিলেটে। আতঙ্কে দিন পার করছেন সুনামগঞ্জবাসীরাও। চারদিকে বন্যার পানি। কোনো কোনো সড়কে নৌকা চলছে। তলিয়ে গেছে মানুষের বসতঘর, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যাদের বসতঘরে পানি, তারা আছেন বেশি কষ্টে।
অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। কেউবা পরিবার নিয়ে উঠেছেন হোটেলে। আবার কেউ কেউ আছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। এ ছাড়া মৌলভীবাজার, কক্সবাজার, নেত্রকোনা, লালমনিরহাটেরও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
সিলেট: এবার যেন বন্যাই নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে সিলেটবাসীর। মাত্র ২ সপ্তাহের ব্যবধানে আবারও প্লাবিত গোটা সিলেট জেলা ও নগরী। সরকারি হিসাবে বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যা ৮ লাখ ছাড়িয়েছে। এর আগে গত ২৯ মে থেকে সিলেট জেলার ৭ উপজেলা ও ২ জুন থেকে সিলেট নগরীর ২৮টি ওয়ার্ড প্লাবিত হলে পানিবন্দি হয়ে পড়েন ৫ লক্ষাধিক মানুষ। প্রথম দফা বন্যার পানি নামতে না নামতেই ১৫ জুন থেকে দ্বিতীয় দফা বন্যায় আঘাত হানে। এ পর্যন্ত দ্বিতীয় দফা বন্যায় জেলা ও নগরে বন্যাকবলিতের সংখ্যা ৮ লাখ ছাড়িয়েছে।
সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এ সময় পর্যন্ত সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় ২৩টি ওয়ার্ড ও জেলার ১০৬টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এতে ৮ লাখ ২৫ হাজার ২৫৬ জন মানুষ বন্যা আক্রান্ত। এর মধ্যে সিলেট নগরে পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা অর্ধলাখ ছাড়িয়ে গেছে।
সূত্রটি আরও জানায়, সিলেট জেলা ও মহানগর মিলিয়ে ৬৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে নগরীতে ৮০টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১৯ হাজার ৯৫৯ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তবে, বেশিরভাগ মানুষজন নিজের বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীর উঁচু বাসাবাড়ি বা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে অবস্থান করছেন।
সরেজমিন সিলেট নগরীর শাহজালাল উপশহর, যতরপুর, মেন্দিবাগ, শিবগঞ্জ, রায়নগর, সোবহানীঘাট, কালিঘাট, কামালগড়, মাছিমপুর, শেখঘাট, ঘাসিটুলা, তালতলা, জামতলা, বাগবাড়ি, কাজিরবাজার, মদিনা মার্কেট, আখালিয়া, মেজরটিলা ও দক্ষিণ সুরমার লাউয়াই, বরইকান্দি, আলমপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অনেকের বাসাবাড়িতে কোমর পর্যন্ত পানি। নিচু এলাকাগুলোর কলোনি বা বাসাবাড়ি প্রায় পুরোটাই তলিয়ে গেছে বন্যার পানিতে। এতে চরম বিপাকে এসব এলাকার মানুষ। অনেকে গেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে, আবার অনেকে নিজের বাসাবাড়ি ছেড়ে যেতে চাচ্ছেন না।
সিলেট সদর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুরসহ কয়েকটি উপজেলার প্রামীণ অনেক রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অনেক কৃষিজমির ফসল তলিয়ে গেছে, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। পানিবন্দিদের উদ্ধারে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় তৎপরতা চালানো হচ্ছে। বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়গুলোতে কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়েছে। বন্যার্তদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ইউনিয়নভিত্তিক ১৬৮টি মেডিকেল টিম গঠন করে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস জানান, বুধবার বেলা ৩টায় সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে ৩৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ ছাড়া কুশিয়ারা নদীর আমলসিদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৯৯ ও শেরপুর পয়েন্টে ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি বইছিল। সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব হোসাইন জানান, ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী জানান, সিলেটে বন্যায় আক্রান্ত কোনো মানুষ যেন কষ্ট না পান, তার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে শুকনো খাবারসহ ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের সবার ছুটি বাতিল করে বন্যার্তদের জন্য সার্বক্ষণিক কাজ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভারত থেকে নেমে আসা উজানের পাহাড়ি ঢলের পানিতে আটকেপড়া বন্যাকবলিতদের উদ্ধার করছে উপজেলা প্রশাসন। পানিবন্দি মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশু নিরাপদ স্থানে নেওয়া হচ্ছে রেসকিউ বোটে করে। গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেছেন, রেসকিউ বোটে করে শুধু মানুষজনই না, গবাদিপশু উদ্ধার করে নিরাপদস্থানে নিচ্ছি আমরা।
এদিকে, বৃহস্পতিবার সিলেটের বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। এসময় তিনি বলেন, ‘মিঠামইনে যেটা হয়েছে, সেটার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “নদীর পানি যাতে পাস করে সে ব্যবস্থা আমরা করব। এবারের বর্ষার সময় আমরা দেখব, পানি আটকে যায় কি না? যদি আটকে যায়, সেটার জন্য আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”
এছাড়া, বুধবার নগরীর বিভিন্ন বন্যাকবলিত কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করেছেন দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান। বিকালে নগরীর মিরাবাজার কিশোরী মোহন বালক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণ বিতরণ করেন তিনি। সিলেট নগরীর বন্যা পরিস্থিতি দেখে তাৎক্ষণিক নগদ ১০ লাখ টাকা, ১০০ মেট্রিকটন চাল ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ত্রাণ সহায়তা প্রদান করেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি প্রধানমন্ত্রী গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং প্রতিনিয়ত খোঁজখবর রাখছেন।
অন্যদিকে সিলেটের জকিগঞ্জে বন্যার পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে স্রোতে ভেসে আবদুল হালিম (৫৫) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। তিনি মুহিদপুর গ্রামের মৃত রনই মিয়ার ছেলে ও পেশায় পিকআপ চালক। বন্যার পানিতে সকাল ৯টা দিকে মাছ ধরতে যান আবদুল হালিম। প্রচণ্ড স্রোতে তিনি নিখোঁজ হন। দুপুর ২টার দিকে শাহবাগ মুহিদপুর এলাকায় তার মরদেহ ভেসে উঠে। জকিগঞ্জ থানার এসআই মো মহরম আলী জানান, মরদেহ উদ্ধারের পর ঊর্ধ্বতন কর্মকতাদের অনুমতিসাপেক্ষে ময়নাতদন্ত ছাড়া দাফনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
সুনামগঞ্জ : জেলায় নদীর পানি কমলেও হাওর অঞ্চল ও পৌর শহরের পাড়া-মহল্লায় বাড়ছে। গত মঙ্গলবার সকালে সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ষোলঘর পয়েন্টে সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। গতকাল বুধবার সুরমা নদীর পানি প্রবাহিত হয় ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে। গতকাল ভোর থেকে একটানা বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এতে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নতুন পাড়া, শান্তিবাগ ধোপাখালী, বাঁধনপাড়া, বলাকা, মোহাম্মদপুর, ষোলঘর, নবীনগর, কাজির পয়েন্টসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি বেড়েছে। সুনামগঞ্জে প্রায় ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, এক তলা বা কাঁচাঘরে থাকা মানুষজন নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন। সবার চোখেমুখে ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার আতঙ্ক। তবে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন নিম্নআয়ের মানুষজন। ঝাওয়ার হাওরের পাশে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষের ঘরের চাল ছুঁইছুঁই পানি। পরিবার-পরিজন নিয়ে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যাচ্ছেন তারা। এদিকে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় লোকজন।
পাহাড়ি ঢল নেমে আগেই তলিয়ে যাওয়া ছাতক, দোয়ারাবাজার, শান্তিগঞ্জ, জগন্নাথপুর, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, মধ্যনগর, দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানিয়েছেন, সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ষোলঘর পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪০ সেমি ওপর দিয়ে সুরমা নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ছাতক উপজেলায় বিপৎসীমার ১৪৬ সেমি ওপর দিয়ে সুরমা নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়াও দিরাই উপজেলায় ১৬ সেমি ওপর দিয়ে সুরমা নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ১০০, লাউড়ের গড়ে ৭৮, ছাতকে ৮৪ এবং দিরাইয়ে ৭৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। নদীর পানি কমলেও অব্যাহত বর্ষণ বাড়ছে। বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী জানান, জেলায় বানভাসি মানুষের জন্য ৫১৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। শুকনা ও রান্না করা খাবার বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুদ রয়েছে।
মৌলভীবাজার: জেলার সদর, রাজনগর ও কুলাউড়াসহ সাতটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। হাওর অঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চলের রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় ঈদুল আজহার দিনেও ভোগান্তিতে পড়েন মুসল্লিরা। পানিবন্দি অনেক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠছেন। গত সোমবার ভোর থেকেই মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলায় টানা বৃষ্টিপাত হয়। এতে করে হাকালুকি, কাউয়াদিকীসহ হাওর এলাকা ডুবে যায়। জেলার সাতটি উপজেলার প্রায় ২০টি ইউনিয়নের ৫ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, জেলার সর্ববৃহত্তর হাওর হাকালুকিতে পানি বৃদ্ধি হওয়াতে জেলার কুলাউড়া, বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলা হাওর এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। হাকালুকি হাওর পারের ভুকশিমইল ইউনিয়নের প্রায় ৮৫ শতাংশ এলাকা বন্যায় প্লাবিত। সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ড পানিতে তলিয়ে গেছে। মনুমুখ ইউনিয়নেরও কয়েকটি ওয়ার্ডও প্লাবিত হয়েছে। ঈদের দিন ঈদগাহে গিয়ে নামাজ আদায় করতে পারেননি নিম্নাঞ্চলের মানুষ। পশু কুরবানি দিতে গিয়ে পড়েছেন বিড়ম্বনায়। কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়ে রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ ও ফহেতপুরসহ কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার হাকালুকি হাওর এলাকা, রাজনগর ও সদর কুশিয়ারা নদীর পানিতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার নিচু এলাকায় ভারী বর্ষণে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।