‘হায়রে ফেরিঘাটের নৌকা, একটা নৌকা পাইনি বাছাইবার লাগি। লাশ উদ্ধার অইমু হয়ত, জীবিত উদ্ধার অইতে পারতাম না, হয়ত এইটা শেষ পোস্ট।’ আকষ্মিক বন্যায় পানিবন্দি জৈন্তাপুর উপজেলার ময়নারহা খেয়াঘাট এলাকার বাসিন্দা সাজিদুর রহমান সাজন ভয়ে পানিবন্দি পরিবার পরিজনকে নিয়ে বুধবার (২৯ মে) রাতে এমন আকুতি জানিয়ে ফেসবুকে পোস্টটি করেছিলেন। পরে রাতেই স্থানীয়রা তার পরিবারকে উদ্ধার করে আনেন বলে জানান সাজিদুর।
সাজিদুর রহমান জানিয়েছেন, ‘রাতে হু হু করে বাড়তে থাকে পানি। রাত ১০ টার দিকে ঘরে পানি ঢুকে যায়। ১১ টার দিকে ঘরের পানি হাঁটুর উপরে উঠে যায়। কিন্তু ঘরে নারী ও শিশুদের অন্যত্র নেওয়ার জন্য কোনো নৌকা পাচ্ছিলেন না। স্রোতের কারণে কোনো মাঝি নৌকা চালাতে রাজি হচ্ছিল না। এমন অবস্থায় আতঙ্কে ফেসবুকে পোস্ট দেই।’
জানা গেছে, উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সিলেটের জৈন্তাপুরসহ ৫ টি উপজেলায় আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় তিন লাখ মানুষ।
বৃহস্পতিবার (৩০ মে) দুপুর পর্যন্ত পানি দ্রুত বাড়ছে। ফলে আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে সিলেটের সব নদ-নদীর পানি।
পানিতে তলিয়ে যাওয়া উপজেলাগুলো হলো: গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ।
পানিবন্দি মানুষের জন্য জেলায় ৪৭০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এছাড়া পানিবন্দিদের উদ্ধারে প্রস্তুত রাখা হয়েছে সেনাবাহিনীকে।
তবে দুর্গত এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছে, নৌকার অভাবে তারা আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারছেন না। ঢলে নদীরক্ষা বাঁধ ভেঙে পানি লোকালয়ে ঢুকছে।
সিলেটের উজানে ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যের অবস্থান। আসামে ভারি বৃষ্টি হলে পানির ঢল সিলেটের দিকে নেমে আসে। ঘূর্ণিঝড় রিমেলের প্রভাবে গত কদিন ধরে ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে মেঘালয়ে। এতে ঢল নেমে সিলেটের সীমান্তবর্তী পাঁচ উপজেলা তলিয়ে গেছে।
দুর্গত এলাকার বাসিন্দারা জানান, গত সোমবার থেকে ভারি বৃষ্টির সঙ্গে ঢল নামা শুরু হয়। তবে বুধবার বিকেল থেকে অস্বাভাবিক হারে পানি বাড়তে শুরু করে। বুধবার একরাতেই তলিয়ে যায় এই পাঁচ উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা। রাতেই পানি ঢুকে পড়ে এসব এলাকার বেশিরভাগ বাসাবাড়িতে। অনেকের ঘরে গলা পর্যন্ত পানি উঠে যায়। এতে আতঙ্ক দেখা দেয় বন্যাকবলিত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে। উদ্ধারের আকুতি জানিয়ে অনেকেই রাতে ফেসবুকে পোস্টও দেন।
জানা গেছে, গোয়াইনঘাট উপজেলার রুস্তমপুর ইউনিয়ন, লেঙ্গুড়া, ডৌবাড়ি, নন্দীরগাঁও, পূর্ব ও পশ্চিম আলীরগাও, পশ্চিম জাফলং, মধ্য জাফলং ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে। এসব উপজেলার অনেক বাসিন্দাই আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে গবাদিপশু এবং ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন অনেকে।
রুস্তমপুর এলাকার বাসিন্দা ফয়জুর রহমান বলেন, ‘ঘরে কাল রাতে পানি উঠে গেছে। ঘরের শিশু ও নারীদের অন্যত্র রেখে এসেছি। কিন্তু গোয়ালের গরুর কারণে আমি কোথাও যেতে পারছি না। আশপাশের সব জায়গা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গরুগুলো কোথাও নিতেও পারছি না। এভাবে আরও দু-একদিন গেলেই গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিবে।’
ওই উপজেলার সালুটিকর-গোয়াইনঘাট সড়ক তলিয়ে যাওয়ার কারণে যান চলাচল বন্ধ হয়ে উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
সিলেট জেলা ত্রাণ ও পুণবার্সন কর্মকর্তা মো. আব্দুল কুদ্দুস বুলবুল বলেন, ‘সীমান্তবর্তী পাঁচ উপজেলার সবকটি ইউনিয়নই প্লাবিত হয়েছে। তিনলাখের মতো মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুরো জেলায় ৪৭০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ উপজেলার মধ্যে গোয়াইনঘাটে ৫৬টি, জৈন্তাপুরে ৪৮ টি, কানাইঘাটে ১৮টি, কোম্পানীগঞ্জে ৩৫টি ও জকিগঞ্জে ৫৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।’
এদিকে, অনেক সড়ক ডুবে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে পড়েছে যান চলাচল। বন্যার কারণে জাফলং, সাদাপাথরসহ কয়েকটি পর্যটনকেন্দ্রে পর্যটকদের না যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দেওয়া তথ্যমতে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় সুরমা নদী কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৪৫ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারা নদী জকিগঞ্জের অমলশীদ পয়েন্টে ১০২ সেন্টিমিটার, শেওলা পয়েন্টে ৫৬ সেন্টিমিটার, এবং সারি নদীর পানি জৈন্তাপুরের সারিঘাট পয়েন্টে ৮৩ সেন্টিমিটার এবং সারিগোয়াইন নদীর পানি গোয়াইনঘাট পয়েন্টে ৫৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বুধবারের চেয়ে বৃহস্পতিবার সবগুলো নদীর পানিই বেড়েছে।
এভাবে ভারি বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকলে কানাইঘাটে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
কানাইঘাট উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ১নং লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়ন, ২নং লক্ষীপ্রসাদ পশ্চিম ইউনিয়ন, কানাইঘাট সদর, দক্ষিণ বাণীগ্রাম ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে।
কানাইঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা নাসরিন জানান, আকস্মিক ঢল ও বৃষ্টিপাতের কারণে সুরমা ও লোভা নদীর পানি বেড়ে বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যা মোকাবিলায় উপজেলার সবকটি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এদিকে, বৃহস্পতিবার দুপুরে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুনজিত কুমার চন্দের সই করা এক আদেশে বলা হয়েছে, ধলাই নদীর পানি বাড়তে থাকায় এবং পর্যটনকেন্দ্রসমূহ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রসহ সব পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হলো।
এদিকে, সিলেটে বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে জানিয়ে সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মোহাম্মদ সজিব হোসেন বলেন, ‘চলতি মাসের ৩০ দিনে সিলেটে ৭০৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। অথচ গতবছর মে মাসে বৃষ্টি হয়েছিলো ৩৩০ মিলিমিটার।’
আগামী তিন দিন সিলেটে অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোবারক হোসেন আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছে। সব উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের সার্বক্ষণিক তদারকি করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারে সেনাবাহিনী প্রস্তুত রয়েছে। প্রয়োজন হলেই তারা তৎপরতা শুরু করবে।