নুরুল হক শিপু : :
আপনি নিজেই চেষ্টা করে দেখুন প্রাণের একটা সংজ্ঞা লেখার, দেখবেন কেমন যেন বেকায়দায় পড়ে গেছেন। এটা স্বাভাবিক, সর্বযুগের লোকেরাই এটা নিয়ে দ্বন্দ্বে ছিলেন এবং আছেন। তারপরও আমরা জীবন্ত সবকিছুর সাধারণ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করে বলি যে, এগুলো থাকার অর্থই হলো ‘প্রাণ’। এখানে প্রাণ বলতে মানুষের জীবন বুঝাতে চেয়েছি। এ সুন্দর ধরায় কিছু মহৎপ্রাণ মানুষ হয়তো আসেন ক্ষণিকের জন্য। অনেক স্মৃতি রেখে আবার প্রাণহীন হয়ে ফিরে যান নাফেরার দেশে। তেমনই একজন হলেন জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, সিলেট জেলা জাপার তিবারের সাধারণ সম্পাদক, ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ আবুল কাশেম মন্টু। তিনি কারো কাছে ছিলেন প্রিয় নেতা, সিলেটের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের কাছে ছিলেন একজন সালিশি ব্যক্তিত্ব, তাঁর সন্তানদের কাছে ছিলেন প্রাণের চেয়ে প্রিয় বাবা, নিজ দল জাতীয় পার্টির নেতাদের কাছে ছিলেন একজন অভিভাবক আর আমার জীবনে তিনি শুধু একজন অভিভাবকই নন; তিনি ছিলেন আমার প্রেরণার উৎস। প্রিয় মন্টু ভাই আমাকে খুব বেশি আদর করতেন, শাসনও করতেন। আমার কাজের বেলায় তাঁর সহযোগিতা থাকত ছায়ার মতো। তাঁর প্রেরণায়ই আজ আমি সাংবাদিকতার পেশায় নিয়োজিত।
মন্টু ভাইয়ের সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল গত সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর)। তখন সকাল সাড়ে ১১টা। আমি তখনো ঘুমে। মোবাইলফোনের রিংটোনে আমার ঘুম ভাঙল। মন্টুভাই ফোন করেছেন। ভাইকে সালাম দিলাম। প্রতি উত্তরে তিনি বললেন, তুমি কী এখনো ঘুমে, তুমি আমাকে দেখতে আসবে না। আমি বললাম, ভাই কী হয়েছে আপনার। জানালেন, ৪ দিন থেকে তিনি নর্থইস্ট মেডিকেল হাসপাতেলে ভর্তি রয়েছেন। বললাম, ভাই আমি আসছি। বাড়ি থেকে বেরিয়েই সোজা অফিসে গেলাম। ‘জাপার কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ আবুল কাশেম মন্টু অসুস্থ, দোয়া কামনা’ নিউজ লিখে সকল পত্রিকায় ইমেইল করলাম। রাত ১১টায় হাসপাতাল গেলাম। সালাম দিয়ে অল্প কথা হলো। তিনি বললেন, জাতীয় পার্টির সকল নেতাকে যেন জানাই তিনি অসুস্থ। সবাইকে জানানোর চেষ্টা করলাম, অনেকেই মোবাইলফোন রিসিভ করেননি। আসার সময় তিনি আমাকে বললেন, ‘শিপু আমি হয়তো এবার আর ভালো হয়ে ফিরব না।’ কথাটা শুনে আমার হৃদয়ে যেন এক অজানা আতঙ্ক দেখা দিল। মন্টু ভাইকে বললাম, আপনি অযথা চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু কিছুই ঠিক হলো না। প্রিয় মন্টু ভাই পর দিন (২০ সেপ্টেম্বর) মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় চলে গেলেন না ফেরার দেশে। (২১ সেপ্টেম্বর) বুধবার তাঁর জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয় বেলা ২টায়। শত শত ভক্ত আর নেতাকর্মী চোখের জলে বিদায় দিলেন আমার প্রিয় মন্টু ভাইকে। শোকে স্তব্ধ আমি। আমার চোখে জলও আসছে না। এক ফোঁটা চোখের পানিও আমি ফেলিনি তাঁর জন্য। আমার জন্য মন্টু ভাইয়ের দেওয়া শ্রম আর অবদানের সব কথা যেন মন্টু ভাইয়ের মৃত্যুর সাথে সাথে মুছে গেছে। যাই হোক, প্রিয় মন্টু ভাইয়ের যখন দাফন শেষ, সবাই সবার মতো চলে গেলেন। আমিও অফিসে গেলাম। ‘চিরনিদ্রায় শায়িত জাপার কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ আবুল কাশেম মন্টু’ শিরোনামে নিউজ করে সকল পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলাম। বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) বাড়ি ফিরে রাত ১টায় ভাত খেতে টেবিলে গেলাম। মুখ দিয়ে খাবার ঢুকছে না। হাতটা ধুয়ে বিছানায় গেলাম। বালিশে মাথা লাগাতেই মনে পড়ল মন্টু ভাইয়ের সকল অবদানের কথা। চোখ আর শান্ত রাখতে পারলাম না। দু’চোখ যেন বাধ মানছে না। মন্টু ভাইয়ের প্রতিটি উপদেশ আর কথা কানে বাজতে লাগল। ভোর হয়ে যাচ্ছে ঘুম নেই, চোখে শুধুই জল। ঘুম থাকবেই কীভাবে?
প্রিয় মন্টু ভাইয়ের জন্যই যে আমি আজকের শিপু। ভালো পত্রিকায় কাজ করতে হবে। ভালোভাবে চলতে হবে-এসব ছিল মন্টু ভাইয়ের প্রতিদিনেরই আদেশ। সপ্তাহে অন্তত দু থেকে তিনবার ফোনে আমার খবর নিতেন। বিশেষ করে সবুজ সিলেটের একজন নিয়মিত পাঠক হিসেবে যখনই আমার কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পড়তেন, সাথে সাথে ফোন করে বলতেন ‘তুমিতো আজ হিট।’ আমার করা কোনো জটিল সংবাদ দেখলে সাহস দিতেন। বলতেন, ‘বাঁচতে হলে বীরের মতোই বাঁচতে হয়। চালিয়ে যাও।’
মন্টু ভাইয়ের মৃত্যুর পর সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, সিলেট-২ আসনের সংসদ সদস্য ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী এহিয়া, জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য আতিকুর রহমান আতিকসহ অনেকেই আমাকে ফোন করেছেন। ফোনে তাঁদের কান্না প্রমাণ করেছে, মন্টুভাই ছিলেন অনন্য এক ব্যক্তিত্ব।
আমার বাবার মৃত্যুর পর একজন অভিভাবক ও দিঙ্নির্দেশক ছিলেন মন্টু ভাই। মন্টু ভাই আজ আপনি অন্ধকার কবরের বাসিন্দা, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি যে আপনাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছি। আপনার কাছে আমি চিরঋণী।