হযরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ডিপারচার এলাকায় গত ২৬ অক্টোবর দুপুরে বাগবিতণ্ডায় জড়ান দুই পুরুষ এবং দুই নারী। পুরুষদের নাম ম্যা প্যাঙ্গুয়ে ও তিয়ান জেঙ্গুইন। তারা চীনের নাগরিক। আর নারীরা হলেন মালিনা মারাক (১৯) ও রানী আক্তার (২৬), বাংলাদেশি।
চীনের উদ্দেশে এই চারজনের ফ্লাইট ছিল সেদিন বেলা ২টা ৫৫ মিনিটে। বিমানবন্দরে আসার পর মালিনা ও রানী বুঝতে পারেন, বিয়ের প্রলোভন ও উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে তাদের চীন নেওয়া হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে তারা দুই চীনা নাগরিকের মাধ্যমে পাচারের শিকার হতে যাচ্ছেন। তাই তারা ম্যা প্যাঙ্গুয়ে ও তিয়ান জেঙ্গুইনের সঙ্গে যেতে রাজি হচ্ছিলেন না।
এ সময় বিমানবন্দরে নিরাপত্তায় নিয়োজিত এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্স (এভসেক) ঘটনাস্থল থেকে চারজনকে আটক করে। পরে চীনা নাগরিকদের বিরুদ্ধে মানব পাচার আইনে মামলা করতে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহযোগিতা চায় এভসেক।
দায়িত্বরত এপিবিএন সদস্যরা এভসেকে জানান, ঘটনাস্থলে এপিবিএন সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন না। বর্তমান বাস্তবতায় ঘটনাটি ঘটেছে এপিবিএনের অধিক্ষেত্রের বাইরে। তাই ফার্স্ট রেসপন্ডার হিসাবে এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে এভসেককেই উদ্যোগী হতে হবে। পরে এভসেক থেকে এপিবিএনকে অনুরোধ করা হয়, ‘আমরা সিআইডির মানব পাচার টিমের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছি। আপাতত আটককৃতদের আপনাদের হেফাজতে রাখা হোক।’
এভসেকের অনুরোধে একটি জিডিমূলে ওই যাত্রীদের রাত ১১টা ৫ মিনিট পর্যন্ত রাখা হয়। এরপর অপর জিডিমূলে তাদের এভসেক অফিসার আলমগীর হোসেনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রাত ১২টার পর কোনো আইনি পদক্ষেপ ছাড়াই চার যাত্রীকেই নিজ নিজ জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে চারজনই আগমনী ক্যানোপি-২ দিয়ে টার্মিনাল ভবনের বাইরে চলে যান।
কেবল এই একটি ঘটনাই নয়; আরও নানা ঘটনায় নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। দায়িত্বরতদের অবহেলা এবং অনভিজ্ঞতার বিষয়টি চোখে পড়ছে প্রতিনিয়ত। চেয়ারে অস্ত্র রেখে খালি হাতে দায়িত্ব পালনের ঘটনাও ঘটছে। থমকে পড়েছে অপরাধী গ্রেফতার ও চোরাচালান পণ্য উদ্ধার কার্যক্রম। গত তিন মাসে এ সংক্রান্ত সাফল্য নেই বললেই চলে। বেড়েছে লাগেজ কাটা পার্টির তৎপরতা। আর এই অবস্থা তৈরি হয়েছে এভসেক এবং এপিবিএনের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিমানবন্দর থেকে তাদের কার্যক্রম অনেকটা গুটিয়ে নেয় এপিবিএন। এমন প্রেক্ষাপটে বিমানবাহিনী থেকে পাঁচ শতাধিক জনবল নিয়োজিত করা হয় বিমানবন্দরে। পরে ১১ আগস্ট এপিবিএন সদস্যরা দায়িত্ব পালন করতে গেলে বাধার মুখে পড়েন। গত ২৮ অক্টোবর গভীর রাতে অ্যাপ্রোন এলাকায় এপিবিএনের অফিসটি দখল করে এভসেক সদস্যরা।
এ ঘটনায় ২৯ অক্টোবর এপিবিএনের পক্ষ থেকে বিমানবন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। অ্যাপ্রোন এলাকা বলতে বোঝায় ভেতরের অংশ-যেখানে বিমান পার্ক করা, মালামাল লোড-আনলোড, রিফুয়েল এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।
সূত্র জানায়, এক সময় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রেটিং ছিল থার্ড ক্যাটাগরিতে। ওই সময় এই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। অবাধ চোরাকারবারসংক্রান্ত অভিযোগ ছিল। যাত্রী হয়রানি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। পার্কিংয়ে ছিল না কোনো শৃঙ্খলা। পরিবহন শ্রমিকদের দৌরাত্ম্য ছিল চরমে। এমন পরিস্থিতিতে ২০১০ সালের ১ জুন বিমানবন্দরে নিরাপত্তার কাজ শুরু করে এপিবিএন।
গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত বিমানবন্দরের তিনটি অংশে (আউটার, টার্মিনাল ভবন ও এয়ারসাইড বা ভেতরের অংশ) প্রায় এক হাজার ২০০ জনের বেশি এপিবিএন সদস্য দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন কেবল আউটার অংশে (ক্যানোপি থেকে রাস্তা) দায়িত্ব পালন করেন তারা। এটা মূলত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কাজ। এতে যুক্ত আছেন এপিবিএননের ৬০০ সদস্য।
অপরদিকে দুটি সরকারি সংস্থার বিরোধের কারণে এয়ারপোর্টের দুই অংশে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না এপিবিএনের ৬০০ সদস্য। মূলত তিন মাস ধরে তারা বসে বসেই বেতন নিচ্ছেন। অপরদিকে এপিবিএনের বিকল্প হিসেবে যাদের দিয়ে দায়িত্ব পালন করানো হচ্ছে তাদের পেছনে গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের ভাতা।
এপিবিএন-১৩ এর কমান্ডিং অফিসার (সিও) সিহাব কায়সার খান গণমাধ্যমকে জানান, বিমানবন্দরে আমরা দায়িত্ব পালন শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত এক হাজার কেজির বেশি স্বর্ণ জব্দ করেছি। ইয়াবা জব্দ করেছি ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৬৩২ পিস। এছাড়া ৬৬ হাজার ৩৫৪ কার্টন সিগারেট, ২ হাজার ৮৪৭ বোতল বিদেশি মদ, ৫১ কেজি গাঁজা, ৩০ হাজার ১৬৬ কেজি কসমেটিক্স, সাড়ে ৮ কেজি সলিড কোকেন, সাড়ে ৮ হাজার মোবাইল, ২১ হাজারের বেশি শাড়ি, ৯৯০ কেজি জুয়েলারি সামগ্রী জব্দ করেছি। এর আর্থিক মূল্য প্রায় সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা।
এর পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেটেটের মাধ্যমে জরিমানা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে ২৬ কোটি ৩১ লাখ ২ হাজার ৩৬০ টাকা। কিন্তু গত তিন মাসে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম শূন্যের কোঠায়। কারণ এয়ারপোর্টে এখন যারা দায়িত্ব পালন করছে এগুলো তাদের কাজ নয়। তাই তারা করছে না।
অপরদিকে আমাদের অধিভুক্ত কাজ হলেও করতে দেওয়া হচ্ছে না। এ কারণে বিমানবন্দরে অপরাধ তৎপরতা বাড়ছে। বেশি সুযোগ নিচ্ছে স্বর্ণ চোরাকারবারিরা। কেন আমাদের দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া হচ্ছে তা আমার বোধগম্য নয়।
জানতে চাইলে সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, নিরাপত্তাজনিত আমাদের কোনো সমস্যা নেই। পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করছে। কারও সঙ্গে কোনো ঝামেলা হচ্ছে না। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু বিষয় নিয়ে শুধু শুধুই বিতর্ক হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করছি। একটা সময় আসবে যখন এভসেক পুরো এয়ারপোর্ট নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে। তখন অন্য কেউ এই দায়িত্ব পালন করবে না।
গত তিন মাসে আসামি গ্রেফতার এবং চোরাচালান পণ্য উদ্ধার কেন শূন্যের কোঠায়-জানতে চাইলে সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান বলেন, আমরা সব দিক দিয়েই ভালো করার চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে আপনাদের সহযোগিতা প্রত্যাশা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আটকের পর মানব পাচারকারীদের ছেড়ে দেওয়ার যে অভিযোগ এসেছে সে বিষয়ে আমি অবগত। এ বিষয়ে এভসেক আমাকে জানিয়েছে, ‘যা হয়েছে সবই আইন মেনে করা হয়েছে।’ এ বিষয়ে এভসেকের পক্ষ থেকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হবে।