দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মিশন। এতে বলা হয়েছে- ‘এই নির্বাচেন বাংলাদেশ সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। পাশাপাশি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার অর্থ্যাৎ সমাবেশ, সমিতি, আন্দোলন ও বক্তৃতায়ও সীমাবদ্ধতা ছিল। অথচ এই বিষয়গুলো প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য।’
রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিচারিক কার্যক্রম এবং গণগ্রেপ্তারের মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা মারাত্মকভাবে সীমিত হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক দলগুলোর আসন ভাগাভাগি চুক্তি এবং আওয়ামী লীগের নিজস্ব প্রার্থী ও দলের সাথে যুক্ত ‘স্বতন্ত্র প্রার্থীদের’ মধ্যে প্রতিযোগিতা ভোটারদের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়নি। মিডিয়া এবং সুশীল সমাজও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সহায়ক ছিল না, সমালোচনামূলক পাবলিক বিতর্কও সীমিত ছিল।
১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সাংবিধানিক সময়রেখা মেনে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ দল টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিলো । এই নির্বাচন ছিল একটি অত্যন্ত মেরুকৃত রাজনৈতিক পরিবেশে পরিচালিত। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও তার জোট শরিকরা নির্বাচন বয়কট করায় সত্যিকারের প্রতিযোগিতার অভাব ছিলো। বিরোধীরা সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচন পরিচালনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়েছিলো, যা প্রত্যাখ্যান করা হয়। প্রাক-নির্বাচনকালীন সময়ে বিরোধী দলের ধারাবাহিক বিক্ষোভের অংশ হিসেবে ব্যাপক সহিংসতা ঘটে।
পরবর্তীতে বিএনপি নেতাদের গণগ্রেপ্তার ও আটকের ফলে দেশের নাগরিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের উল্লেখযোগ্য অবনতি হয়। নির্বাচনের পুরো সময় জুড়ে বিরোধী দলগুলোর সমাবেশ, সমিতি, আন্দোলন এবং বক্তৃতার স্বাধীনতা কঠোরভাবে সীমিত করা হয়। গ্রেপ্তার এড়িয়ে যে কোনও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষমতা বিএনপির পক্ষে অসম্ভব ছিল কারণ প্রায় সব সিনিয়র নেতৃত্বকে কারাবন্দি করা হয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঠেকাতে ফৌজদারি অভিযোগ গঠন ব্যাপকভাবে একটি কৌশলের অংশ হিসাবে অনুভূত হয়েছে। বিশ্বাসযোগ্য গণতান্ত্রিক আচরণের জন্য মৌলিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার অপরিহার্য, যা বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক চুক্তিতে বলা আছে। কিন্তু এই অধিকারগুলো ক্ষুণ্ন করা হয় আইন দ্বারা যা অযথা বাক স্বাধীনতার অধিকারকে সীমাবদ্ধ করে।
সমান ভোটাধিকারের নীতিকে পুরোপুরি সম্মান করা হয়নি। বিদ্যমান আসনের সীমানা নির্ধারণের ভিত্তিতে সংসদীয় আসন প্রতি ভোটার সংখ্যায় তারতম্য লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ন্যূনতম আইনি প্রয়োজনীয়তা মেনে চলে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ তার আইনি আদেশের এখতিয়ারের মধ্যে ছিলো এবং লজিস্টিক প্রস্তুত ছিল। তবে কমিশনের ব্যাপক ক্ষমতা থাকলেও আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। তাই তারা একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন দিতে সক্ষম হয়নি বলে মনে করে কিছু স্টেকহোল্ডার। তাদের ধারণা, ভোটদান এবং গণনা প্রক্রিয়ার সময় কমিশনের স্বাধীন মর্যাদা সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত করা হয়নি। স্টেকহোল্ডারদের মতে, ভোটার নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছে যার ফলে নিয়মিত আপডেট এবং ডেটা মিলেছে। ১ জানুয়ারি ২০২৩ এর মধ্যে যারা ১৮ বছরে পৌঁছায়নি তারা এই নির্বাচনে ভোট দিতে অযোগ্য ছিলেন।
ফলস্বরূপ, ২০২৩ সালে ১৮ বছর বয়সে পৌঁছেছেন এমন ব্যক্তিদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানোর অযোগ্যতার কিছু কারণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। অযথাই প্রার্থীদের অধিকারকে সীমিত করা হয়। নির্বাচনী প্রচারণা সমাবেশ যেমন আন্দোলন এবং বক্তৃতার স্বাধীনতার উপর ব্যাপক সীমাবদ্ধতার প্রতিফলন ঘটে। যার ফলে একটি সম্পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের অভাব ছিলো। নির্বাচনী প্রচারের সময়কাল অতিমাত্রায় নির্দেশমূলক আইনি বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগই ছিল একমাত্র রাজনৈতিক দল যে বৃহৎ প্রচার র্যালিসহ যেকোনও উল্লেখযোগ্য জনসাধারণের কার্যক্রম সংগঠিত করতে পেরেছে।
প্রার্থীদের উপর প্রচারণা ব্যয়ের সীমা আরোপ করা হয়েছিল। আর্থিক সীমা অবশ্য ছিল খুব কম এবং প্রচার কার্যক্রম ছিল সীমিত। এটি ব্যয়ের আন্ডার রিপোর্টিংকেও উৎসাহিত করেছে এবং প্রার্থীরা তাদের প্রচারণার জন্য তহবিল দেয়ার নিয়ম এড়িয়ে গেছেন। অনলাইন বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণকারী-সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ বিশেষ করে মিডিয়া এবং অনলাইনে বাকস্বাধীনতার উপর এর প্রভাবের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে। পূর্ববর্তী আইনে কিছু প্রান্তিক উন্নতি সত্ত্বেও তা আন্তর্জাতিক মানের হয়নি। অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং অস্পষ্ট বিধানগুলি অযৌক্তিকভাবে অনলাইনে সীমাবদ্ধ করে।
সংসদে নারীরা কম প্রতিনিধিত্ব করে এবং জনজীবন ও নির্বাচিত পদে পূর্ণ অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে চলেছে। মাত্র ২০ জন নারী নির্বাচিত হয়েছেন, এটাই সংসদে সরাসরি নির্বাচিত আসনের ৬.৬ শতাংশ। আরও ৫০টি আসন সংরক্ষিত রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত আসনের অনুপাতের উপর ভিত্তি করে। অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহারের ফলে উল্লেখযোগ্য চাপ এবং স্ব-সেন্সরশিপ হয়েছে এই সেক্টরে। অভ্যন্তরীণ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে স্বচ্ছতার অভাব ভোটকেন্দ্রের স্তর ক্ষুণ্ন করেছে। নির্বাচনের কোনো স্বাধীন মূল্যায়ন নির্দলীয় নাগরিক সমাজ দ্বারা পরিচালিত হয়নি ।
প্রাক-নির্বাচনের আবেদনগুলো সবই প্রার্থী মনোনয়ন সংক্রান্ত ছিল। প্রার্থী প্রথমে নির্বাচন কমিশনে এবং পরে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতে পারেন। এগুলো মোকাবিলা করা হয় দ্রুতগতিতে। যদিও আন্তর্জাতিক অধিকার পূরণে কিছু ত্রুটি ছিল। বেশ কয়েকজন মন্তব্য করেছেন যে এর জন্য খুব কম সময় দেয়া হয়েছে। এই মামলা নিষ্পত্তির জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয়নি। কেউ কেউ মনে করেন, আদালত কিছু অসামঞ্জস্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যার দ্বারা কিছু নির্দিষ্ট মানুষ উপকৃত হয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতিও আস্থার অভাব ছিল। প্রচারণা এবং নির্বাচনের দিন আদর্শ আইন এবং আচরণবিধি প্রয়োগ অসঙ্গত ছিল। রিপোর্ট করা হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন এগুলোকে অযথা নম্রভাবে মোকাবেলা করেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে কঠোরতা দেখিয়েছে।
সাধারণভাবে সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খলভাবে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নির্বাচনের দিন সহিংসতার বিচ্ছিন্ন ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে। ব্যালট বাক্স ভর্তি এবং জালিয়াতির প্রচেষ্টাসহ নির্বাচন কমিশন স্থানীয় প্রার্থীরা ভোটে অনিয়মের অভিযোগ করেছেন । এর মধ্যে কয়েকটির তাতক্ষণিকভাবে মোকাবিলা করা হয়েছিল। ২৫টি ভোট কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। তবে অন্যান্য ঘটনা অবহেলিত ছিল এবং পর্যাপ্তভাবে তদন্ত করা হয়নি। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত চূড়ান্ত ভোটের হার ছিল ৪১.৮ শতাংশ। এটাই সারা দেশে ব্যাপক বৈষম্যের চিত্র প্রদর্শন করে। চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিক ফলাফল অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল প্রার্থীরা ২২৩টি আসন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২টি, জাতীয় পার্টি পায় ১১টি আসন। আসন ভাগাভাগির চুক্তিতে আরও দুটি দল একটি করে আসন পেয়েছে। চূড়ান্ত আসনটি কল্যাণ পার্টি জিতেছে।
নির্বাচনী কিছু এলাকায় উন্নতির জন্য কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হলো:
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ সহ সংসদীয় সম্পর্কিত সমস্ত আইন, প্রবিধান এবং বিধিগুলোর একটি ব্যাপক পর্যালোচনা আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আইনি নিশ্চয়তা বাড়াতে পারে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনার বোর্ড নিয়োগের ব্যবস্থা যোগ্যতাভিত্তিক ও স্বাধীন নিয়োগের মাধ্যমে হওয়া উচিত। যা জনস্বার্থে কাজ করার লক্ষ্যে কমিশনের হাত শক্তিশালী করবে। সর্বোত্তম অনুশীলনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি স্বাধীন প্যানেল বিষয়টি তত্ত্বাবধান করতে পারে।
বাকস্বাধীনতার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের বিধান মেনে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট, ২০২৩-এর বিধানগুলির পর্যালোচনা করতে হবে। অস্পষ্ট এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিধিনিষেধগুলি সরানো যেতে পারে। সুশীল সমাজ যাতে নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য বিদেশি অনুদান (স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম) আইনের বিধান, ২০১৬ এর সীমাসহ সুশীল সমাজের কার্যক্রম এবং অতিমাত্রায় এর ওপর আমলাতান্ত্রিক নিবন্ধনের বিষয়টি পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
ভোট ও গণনার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য বর্ধিত সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা যেতে পারে। তার জন্য ভোট কেন্দ্রের আশেপাশে রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমের উপর সম্পূর্ণ স্থগিতাদেশ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।