অপূর্ব শর্মা ::
কিছু কিছু দৃশ্য আছে বার বার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ইচ্ছে করলেও সেই দৃশ্যগুলো চোখ থেকে সরানো যায় না। যশোরের মনিরামপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান কর্তৃক বয়স্ক চারজন নাগরিককে কান ধরানোর দৃশ্যটি দেখার পর থেকে একই অবস্থা হয়েছে আমার। অনেক চেষ্টা করেও এ ঘটনাটি ভুলতে পারছি না। অমানবিক এই দৃশ্যটি শুধু আমাকে নয়, আমার মতো অগণন মানুষকে একই অবস্থায় ফেলেছে। ঘর থেকে বাইরে বের হওয়ার অপরাধে প্রকাশ্যে তাদের সাথে এমন ব্যবহার করেন এসিল্যাল্ড। এবং নিজেই সেই দৃশ্য মোবাইলবন্দি করে ভূমি অফিসের অফিসিয়াল পেইজে সেই ছবিকে বানিয়েছেন কাভার ফটো!
এ ছবিটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সমালোচনার মুখে পরদিন প্রথম প্রহরে তাকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কিন্তু প্রত্যাহার করে নিলেও এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে গণমাধ্যম এবং নেট দুনিয়ায়। নানাজন নানা কথা বলছেন বিষয়টি নিয়ে। প্রত্যেকেই নিন্দে করছেন ঘটনার। ডিসিকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতে, মনিরামপুরের ঘটনা মাঠ পর্যায়ে অনেক প্রশাসনিক কর্মকর্তার সাধারণ মানুষের প্রতি ব্যবহারের বিষয়টি আবারো সামনে নিয়ে এসেছে। এই পরিস্থিতিতে জাতির জনকের একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণটি অনেকেই নিজ নিজ ফেসবুক একাউন্টে আপলোড করেছেন। এধরণের কর্মকর্তাদের উপর ক্ষুব্ধ হয়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন,
‘সরকারী কর্মচারীদের বলি, মনে রেখো, এটা স্বাধীন দেশ। এটা ব্রিটিশের কলোনী নয়। পাকিস্তানের কলোনী নয়। যে লোককে দেখবে, তার চেহারাটা তোমার বাবার মত, তোমার ভাইয়ের মত। ওরই পরিশ্রমের পয়সায় তুমি মাইনে পাও। ওরাই সম্মান বেশী পাবে। কারণ, ওরা নিজেরা কামাই করে খায়।’
‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনে দেয় ঐ গরীব কৃষক। আপনার মাইনে দেয় ঐ গরীব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। আমরা গাড়ি চড়ি ঐ টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই মালিক। ওদের দ্বারাই আপনার সংসার চলে।’
প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের এ ধরনের ব্যবহার যে নতুন কোনও ঘটনা নয়, সেটি বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য থেকে সহজে অনুমান করা যায়। স্বাধীনতা পরবর্তীতে এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদেরকে যেমন হর্তা-কর্তা ভেবেছিলেন আজও ঠিক একই অবস্থা তৈরি হয়েছে। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেখানে জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক এবং উৎস সেখানে জনতার প্রতি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের এ ধরনের আচরণ বিবেক সম্পন্ন প্রতিটি মানুষের মনকেই করে ক্ষতবিক্ষত। অনেকে এ নিয়ে কথা বলেন, আবার অনেকে এড়িয়ে যান মান-সম্মানের ভয়ে। দেশে এমন কোনও অফিস পাবেন না যেখানে এইসব ‘অভদ্র’ কর্মচারী নেই। আপনার সমস্যাকে একদিকে যেমন জটিল করে তুলে তারা অন্যদিকে মনকে করে বিষাদগ্রস্থ। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে থানা-সর্বত্রই পাবেন এদের দেখা। সম্মানতো দূরে থাক হাসিমুখে কথা বলতেও জানেনা তারা।
আমরাই এসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মাথায় তুলেছি। এসব সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী জনগণের সাথে যথেচ্ছার করার সুযোগ পাচ্ছেন, আমাদের রাজনীতিবিদদের দুর্বলতার কারণে। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং সমর্থনের কারণেই তারা হয়েছেন পোয়াবারো। সে কারণে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করেন না। মানবিক আচরণ করতে ভুলে যান তারা। মাথার উপরে অমুক-মন্ত্রী, অমুক এমপি আছেন, কে কি করবে আমার? তাই তারা চলাচল করেন বেপরোয়াভাবে। আমরা যারা সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত তারা এটা ভালো করেই জানি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব পোস্টে যারা বদলী হন বা বদলী হয়ে আসেন তারা স্থানীয় এমপি, মন্ত্রী এবং রাজনীতিবিদদের আশীর্বাদপুষ্ট হন। নইলে কোনওনা কোনও সচিবের আশির্বাদ থাকে তাদের মাথার উপর। সেই সাথে অনেক ক্ষেত্রে এসব পোস্টে বদলীতে থাকে টাকার খেলা। ভূমির অন্তহীন সমস্যার এই দেশে মানুষ সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হন ভূমি অফিস দ্বারা। ভূমি জটিলাতার কারণে অনেককে যেমন দিনের পর দিন এই অফিসে ধর্না দিতে হয় মানুষকে, তেমনই এই অফিস দ্বারা হয় জনতার পকেট খালি হয়।
একদিকে টাকা, অন্যদিকে ক্ষমতা, সেইসাথে প্রভাবশালীদের সমর্থন এবং দলীয় অনুকম্পা- এসব কারণে দেশের মালিকদের সাথে এমন আচরণ করতে কুন্ঠাবোধ করেন না তারা। এমন আচরণ করে অনেকে পুরস্কৃত হয়েছেন অতীতে। তবে এবার তাৎক্ষণিকভাবেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে অভিযুক্ত সাইয়েমার বিরুদ্ধে। এবং ‘নিগ্রহের’ শিকার বয়স্ক চার দরিদ্র ব্যক্তির কাছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাওয়া হয়েছে ক্ষমা। শনিবার ওই চারজনের বাড়ি গিয়ে খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষার জন্য মাস্কও দিয়ে এসেছেন মনিরামপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এ সময় চারজনের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব একজন বলেছেন, মুখে মাস্ক না থাকায় তাঁকে যেভাবে বাজারের মধ্যে কান ধরানো হয়েছে, তা লজ্জার, অপমানের।
অন্য আরেকজন বলেছেন, ‘আমি বুড়া মানুষ, বাজারের এতগুলা মানুষের সামনে এভাবে কান ধরে উঠবস করালো লজ্জা পাইছি, অপমান হইছি।’ এই যে অপমান, এইযে লজ্জা, এটা তার একার, নিশ্চয়ই না। এই অপমান, এই লজ্জা বাংলাদেশের প্রতিটি সাধারণ মানুষের। স্বাধীনতার মাসে স্বাধীনতার সুফলভোগিদের দ্বারা এমন আচরণের ক্ষত নিয়েই জীবনের বাকিটা পথ পারি দিতে হবে বয়স্ক এই নাগরিকদেরকে। সাইয়েমা যাদেরকে কান ধরে উঠবস করিয়েছিলেন, এদের তিনজনই ভূমিহীন মানুষ। মাথা গোজার ঠাই নেই তাদের। অন্যজন একটি স্কুলে দপ্তরির চাকরি শেষ করে এখন অবসরে।
প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমরা অনেকেই আবেগতাড়িত হয়ে এই নাগরিকদের সাথে আরেকটি অন্যায় করে ফেলেছি, সেটি হচ্ছে অবমাননার সেই ছবি মুখ না ঢেকে হুবহু প্রকাশ করে সারা দেশে, বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছি। যা কোনওভাবেই উচিত হয়নি আমাদের। এই ছবিটি তাদের, তাদের পরিবারের এবং পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে কি প্রভাব ফেলতে পারে আমাদের সমাজ বাস্তবতায় তা-কি একবারও ভেবে দেখেছি আমরা? নিশ্চয়ই দেখিনি। এটি ভেবে দেখা উচিত ছিলো।
এই ঘটনায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব শেখ ইউসুফ হারুন যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি আমার ভালো লেগেছে। ‘ওই কর্মকর্তা ভুল করেছেন, আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব যেন অন্যরা শিখতে পারে।…সব জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কেউ যেন অকর্মকর্তাসুলভ আচরণ না করেন। কেউ এ ধরনের আচরণ করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা আমরা ডিসিদের দিয়েছি। বলেছি, মনে রাখতে হবে তারা মাস্টার নয়, সেবক; তারা যেন জনগণের সেবা করেন।’ শুধু কথা নয়, এর বাস্তবায়ন চাই আমরা। আমি মনে করি, এই অন্যায়ের জন্য প্রত্যাহারই যথেষ্ট নয়। এজন্য এসিল্যান্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। তাহলে ভবিষ্যতে কোনও সরকারি কর্মচারি এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে সাহস পাবেনা। তাদের আচরণে সরকারের ভাবমূর্তি যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হবেনা তেমনই লজ্জিত হবেনা জাতি।
*লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।